IIEST-Shibpur

অ-বিজ্ঞান

স্বাধীনতার পর নেহরুর নেতৃত্বে যে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রসার ঘটিয়াছিল দেশে, সেই পথ হইতে ভারত ক্রমশ সরিয়া আসিতেছে। সেই জায়গা লইতেছে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০১
Share:

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁহারা শিক্ষা দান এবং গ্রহণ করিতে আসেন, তাঁহাদের একটিই পরিচয়— শিক্ষক, অথবা শিক্ষার্থী। ইহা ব্যতীত ধর্ম, রাজনীতি— সকল পরিচয়ই সেখানে গৌণ। সুতরাং, শিক্ষার কোনও রং নাই। তাহাকে বিশেষ কোনও রঙে রঞ্জিত করা ক্ষমাহীন অপরাধ। অথচ, বিজেপি শাসিত ভারতে বারংবারই শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগ উঠিয়াছে। তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন শিবপুর আইআইইএসটি। সেখানে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তির ভার্চুয়াল কর্মশালা চলিবার কালে ভগবদ্‌গীতা এবং হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের অভিযোগ উঠিয়াছে। শুধুমাত্র তাহাই নহে, কর্মশালার প্রথম দিনটিতে চিফ ওয়ার্ডেন পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করিবার সময় তাঁহার ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’-এর রাজ্য সভাপতির পরিচয়টি দেখানো হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিচয় ঘিরিয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। আরও বলা হইতেছে, যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাঠ দেওয়া হয়, সেইখানে কোনও একটি বিশেষ ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের মাহাত্ম্য প্রচারই বা হইবে কেন?

Advertisement

ভারতের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি সঙ্গত। কারণ, বিজেপিশাসিত ভারতে ধর্ম, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এমন অনেক স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে উদ্যত, যেখানে আদৌ তাহার কোনও প্রয়োজন নাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। কিছু বৎসর পূর্বে হরিয়ানা সরকার বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ভগবদ্‌গীতা অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিল। সম্প্রতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ হইতেও ভগবদ্‌গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ হিসাবে ঘোষণা করিবার এবং ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ রোধ করিতে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষায় গীতাকে অবশ্যপাঠ্য করিবার দাবি উঠিয়াছে। সুতরাং, শিবপুর আইআইইএসটি-র ঘটনাগুলিকে বিচ্ছিন্ন বলিবার উপায় নাই। সত্য যে, গোমাংস ভক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা প্রকাশ্য স্থানে নমাজ পাঠে বিরোধিতার মধ্যে যে সরাসরি সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ প্রকট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করিবার মধ্যে তাহা নাই। কিন্তু পরিণতির কথা ভাবিয়া দেখিলে, উভয়ের মধ্যে তফাতও বিশেষ নাই। ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম শর্ত অন্য ধর্মের প্রতি সম্মানবোধ, সহিষ্ণুতা। সেই গুণটি অন্তর্হিত হইলে ধর্মনিরপেক্ষতার খোলসটুকুই শুধু পড়িয়া থাকে।

শিবপুরের ঘটনায় অবশ্য কর্তৃপক্ষের ভূমিকা লইয়াও প্রশ্ন থাকিয়া গেল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা যাহাতে সংবিধান-বর্ণিত পথে হয়, তাহা দেখিবার দায়িত্বটি কর্তৃপক্ষেরই। তদুপরি, একটি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কর্মশালায় যুক্তিবোধের চর্চা হইবে, ইহাই তো স্বাভাবিক। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যদি নিজ চরিত্র হারাইয়া অন্য পথে হাঁটিতে চাহে, তবে তাহাকে ঠিক দিশাটি দেখাইবার প্রাথমিক এবং প্রধান কর্তব্যটিও কর্তৃপক্ষেরই হওয়া উচিত। অথচ, এই ক্ষেত্রে তেমন হয় নাই বলিয়াই অভিযোগ। ইহা উদ্বেগের বিষয় বইকি। বস্তুত, স্বাধীনতার পর নেহরুর নেতৃত্বে যে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রসার ঘটিয়াছিল দেশে, সেই পথ হইতে ভারত ক্রমশ সরিয়া আসিতেছে। সেই জায়গা লইতেছে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। শিবপুরের ঘটনা সেই ছবিটিকেই আরও একটু স্পষ্ট করিল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন