Protests

বিষাদযোগ

পুজোকে উপলক্ষ করে সামাজিক অন্যায়ের চিন্তাগুলি হয়তো ‘অকারণ বিষাদ’ বলে সরিয়ে রাখা যেত, যদি না পুজোর সঙ্গে রাজনীতি ও রাজ্য প্রশাসনের সংযোগ এমন নিবিড় হয়ে উঠত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:০১
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

নিয়োগের আশায় শিক্ষক পদপ্রার্থীদের অবস্থান, বকেয়া মজুরির জন্য সরকারি প্রকল্পে কাজ করা শ্রমিকের আন্দোলন, বোনাসের দাবি করে কাজ-হারানো চা-বাগানের কর্মী, এমন কতশত মানুষের আর্তি ঢেকে গেল ঢাকের বাদ্যিতে। এই মৌলিক চাহিদাগুলি কেবল যে উপেক্ষিত হল তা-ই নয়, কবে এগুলির নিষ্পত্তি হবে, কী করেই বা, সে বিষয়ে কোনও আলোচনা শোনা গেল না। এই উৎসবের মরসুমে সেগুলি গুরুত্ব পাবে, এমন আশাও কম। আগে পুজোর পালা সাঙ্গ হত লক্ষ্মীপুজোয়, তার পরে দীপাবলি বা ক্রিসমাস আসত সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো। এখন কলকাতা-সহ বাংলার শহর-গঞ্জে গণেশপুজো থেকেই শুরু হয় শারদীয় উৎসব, পৌষপার্বণ পার না করে তার শেষ হয় না। তার উপর সামনের বছর আসছে দেশের সাধারণ নির্বাচন, বছর না ঘুরতে দলীয় প্রচারের ঢাকে কাঠি পড়বে। ন্যায়বঞ্চিত, রোজগারহীন, প্রতারিত মানুষের কণ্ঠস্বর ডুবে যাবে বড় নেতাদের কাজিয়া আর কেলেঙ্কারির সংবাদে। দেশের জন্য নব নব সঙ্কটের কল্পনা করবেন নেতারা, জন-আলোচনা ঘুরপাক খাবে সে সব ভয়ানক সম্ভাবনার আবর্তে। দেশের অধিকাংশ মানুষের দাবি-চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জনপরিসরে ‘প্রান্তিক’ করে তোলার এই কৌশল এখন যেন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে উৎসবের আয়োজনেও। জোরালো বাদ্য, চড়া আলোর পিছনে রাজ্যের ন্যায়বঞ্চিত, কর্মবঞ্চিতের হতাশা দাঁড়িয়ে আছে এক অন্ধকার চালচিত্রের মতো। তার সম্মুখে সর্বজন-আরাধ্য, সর্বমঙ্গলার প্রতিষ্ঠা করতে লজ্জা হয়।

Advertisement

পুজোকে উপলক্ষ করে সামাজিক অন্যায়ের এই চিন্তাগুলি হয়তো ‘অকারণ বিষাদ’ বলে সরিয়ে রাখা যেত, যদি না পুজোর সঙ্গে রাজনীতি ও রাজ্য প্রশাসনের সংযোগ এমন নিবিড় হয়ে উঠত। এ রাজ্যে পুজোমণ্ডপগুলি বহু দিনই নেতা-মন্ত্রীদের জনসংযোগের প্রচারমঞ্চ হয়ে উঠেছে। পুজোর বৈভবের সঙ্গে নেতাদের প্রভাবের সম্পর্ক সমানুপাতিক। ফলে ক্ষোভ আরও গাঢ় হবে, এটাই স্বাভাবিক। যে সরকার পুজোর উদ্যোক্তাদের অনুদান স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই সরকারই বহু সরকারি ঠিকাদারের প্রাপ্য অর্থ বাকি রেখেছে, ফলে নানা ধরনের পরিষেবায় ক্রমাগত ঘাটতি হচ্ছে। শিশুর চিত্তরঞ্জক ‘ডিজ়নিল্যান্ড’-এর অনুকরণে মণ্ডপ নিয়ে দর্শকদের উন্মাদনায় চাপা পড়ে যায় রাজ্যের অধিকাংশ শিশুর মিড-ডে মিলের থালা, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেই যার বরাদ্দ কমায় রয়েছে কেবল সয়াবিন আর আলুর স্বাদহীন অবসাদ। যে নেতারা বকেয়া মজুরি আদায়ে বহু শোরগোল তুলে দিল্লি গেলেন, তাঁরাই যে এখন পুজোর উদ্বোধনে ব্যস্ত হয়ে মজুরদের ভুলেছেন, একটি ইস্তাহারে তা প্রকাশ করেছে খেতমজুরদের একটি সংগঠন।

যে কোনও উদ্‌যাপনের প্রধান উপকরণ অন্তরের সম্পদ, তাই অতি অকিঞ্চন মানুষের জীবনও উৎসবহীন হতে পারে না। সামান্য সামর্থ্যকেও একত্র করে যদি সম্মিলিত উদ্‌যাপনের আয়োজন হত, তাতে অনেক অভাবের বোধ পূর্ণ হতে পারত। অতীতে সমাজকল্যাণের কত না উদ্যোগ গড়ে উঠেছে উৎসবের আয়োজন থেকে। আজ রাজনীতিই দখল করে নিচ্ছে সামাজিক মেলামেশা, সহানুভূতির স্ফুরণের সব ক’টি স্থান। তাই পিতৃপক্ষে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে পুজোর উদ্বোধন করে ক্ষমতার স্বাক্ষর রাখতে হয় নেতানেত্রীদের। রাজনীতির অন্তঃস্থিত সমানুভূতির শূন্যতাকে নানা চমক আর বিনোদনের আয়োজন দিয়ে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবু এই সব বিশাল বিচিত্র আয়োজনকে কেবল শূন্যগর্ভ আড়ম্বর বলে বোধ হতে থাকে, যদি তাতে অধিকাংশ মানুষের প্রাণের যোগ না থাকে। যেমন, সামান্য আয়োজনও অসামান্য হয়ে দেখা দেয়, যদি অন্তরের সম্পদে ঢাকা পড়ে যায় বাহ্যিক অপূর্ণতা। পাড়ার মানুষ যে পরিণত হচ্ছেন কেবল দর্শক আর খরিদ্দারে, সেই খামতিই প্রতিফলিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের জন-উদ্যোগে। রাজনীতির অভ্যন্তরের শূন্যতা তারই প্রতিফলন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন