Electoral Bonds

স্বচ্ছতার মৃত্যুসংবাদ

এখন অবধি যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি প্রবণতা স্পষ্ট। এক, বড় মাপের দাতাদের তালিকায় বড় আয়তনের সংস্থা নেই, বরং আছে নিতান্তই কিছু খুচরো সংস্থা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৪ ০৭:২২
Share:

—প্রতীকী ছবি।

নির্বাচনী বন্ডই ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে আজ অবধি বৃহত্তম কেলেঙ্কারি কি না, সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতে মিলবে। বর্তমানে আপাতত বিজেপি নেতারা বিভিন্ন ভাবে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, বন্ডের মাধ্যমে যত টাকা উঠেছে, বিজেপির চেয়ে বিরোধী দলগুলি তার ভাগ পেয়েছে বেশি। ছোটখাটো কোনও নেতা নন, এই দাবি করেছেন স্বয়ং অমিত শাহ। বাস্তব সম্পূর্ণ বিপরীত। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যত টাকা উঠেছে, তার অর্ধেক পেয়েছে একা বিজেপি। কিন্তু, প্রশ্ন সেখানে নয়। ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব চলনকে মানলে বলতেই হয় যে, কেন্দ্রে যে দল বিপুল ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত, টাকার বখরাও তারাই বেশি পাবে। সুপ্রিম কোর্টের বকুনি খেয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে বাধ্য হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, মূলত ব্যবসায়িক সংস্থাগুলিই দাতা। ২০১৭ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ড চালু করায় বাণিজ্যিক সংস্থা প্রদত্ত রাজনৈতিক অনুদানের দু’টি শর্ত পাল্টে যায়— এক, দাতার নাম গোপন রাখার উপায় তৈরি হয়; এবং দুই, কোনও সংস্থার গত তিন বছরের লাভের সঙ্গে রাজনৈতিক অনুদানের পরিমাণের আর কোনও সম্পর্ক থাকে না। সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকে। অন্য সব দলের চেয়ে বিজেপি অনেক বেশি টাকা পেয়েছে, তার চেয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কথা হল, বিজেপি যে ভাবে টাকা পেয়েছে, তার পরে আর ‘স্বচ্ছতা’-র কোনও দাবিই সেই দলের মুখে মানায় না।

Advertisement

এখন অবধি যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি প্রবণতা স্পষ্ট। এক, বড় মাপের দাতাদের তালিকায় বড় আয়তনের সংস্থা নেই, বরং আছে নিতান্তই কিছু খুচরো সংস্থা। সেই সংস্থাগুলির কয়েকটির সঙ্গে বড় সংস্থার যোগসূত্র অনতিপ্রচ্ছন্ন। ফলে, আশঙ্কা জন্মায় যে, দাতা-তালিকায় থাকা এই সংস্থাগুলির বেশির ভাগই হয়তো ‘শেল সংস্থা’— ঘুরপথে বিজেপিকে টাকার জোগান দেওয়ার জন্যই সেগুলির সৃষ্টি। এই বন্ড চালু করার সময় অরুণ জেটলি বলেছিলেন, বৃহৎ শিল্পপতিরা কোনও দলকে রাজনৈতিক অনুদান দিয়ে অপর দলের অপ্রীতিভাজন হতে চান না বলেই পরিচয় গোপন রাখার ব্যবস্থা করা হল। পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে, তাঁর সেই কথাটি অর্থহীন। বিজেপির দাতা-তালিকায় এমন সংস্থাও আছে, যাদের অনুদানের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট অর্থবর্ষে সংস্থার মোট লাভের চেয়ে বেশি, অথবা লাভের সিংহভাগই অনুদানে গিয়েছে। কোনও সংস্থা ধার করে বিজেপিকে টাকা দেবে কেন, এই প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। হিসাব বলছে, দাতা-তালিকায় এমন একাধিক সংস্থা রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে নানান কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করেছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন প্রশ্ন করেছেন, কী করে জানা গেল যে তদন্ত আরম্ভ হওয়ার পরই সংস্থাগুলি বিজেপিকে অনুদান দিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবান্তর। দাতা-তালিকায় এমন সংস্থাও রয়েছে, যারা হঠাৎই বিবিধ লাইসেন্স পেয়েছে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ভাগীদার হয়েছে।

হতে পারে, সবই সমাপতন। কিন্তু, সম্ভাব্যতর ব্যাখ্যা হল, রাহুল গান্ধী যে অভিযোগটি করেছেন, তাতে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে— এক দিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার গাজর, এবং অন্য দিকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার লাঠি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থাকে তাদের তহবিলে অর্থ দান করতে বাধ্য করেছে কেন্দ্রীয় শাসক দল। এই দ্বিতীয় আশঙ্কা সত্য হলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। রাজনীতির ময়দানে বিভিন্ন পক্ষের আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে প্রভূত ফারাক থাকলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তার প্রভাব পড়ে তো বটেই, কিন্তু সেটিই নাগরিকের একমাত্র ক্ষতি নয়। গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্রে এমন অন্যায় পুঞ্জীভূত হলে আর কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকেই ভরসা করার উপায় থাকে না। কোনও দেশের পক্ষে আস্থাহীন নাগরিকের চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হয় না। তবে আস্থা আছে কি না, সে কথা অবশ্য সে দেশের নাগরিকরাই বলবেন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন