Election

গভীর অসুখ

নিরন্তর শক্তিপ্রদর্শন, হিংস্রতা এবং ভীতিপ্রদর্শনের এই সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জমিকে ক্রমশ গ্রাস করছে। বিধানসভার বিতর্কহীনতা তারই অশনিসঙ্কেত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২২ ০৪:৩৬
Share:

নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ আটটি রাজ্যে ২০২১ সালে বিধানসভায় যতগুলি বিল পেশ করা হয়েছে, তার সবই পাশ হয়েছে এক দিনে। অর্থাৎ, যে দিন পেশ হয়েছে বিল, পাশ হয়েছে সেই দিনই। এর মধ্যে রয়েছে ‘ফিনান্স বিল’ অর্থাৎ বাজেটও। পুলিশ, পূর্ত বিভাগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে সরকারি বরাদ্দ কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ হয়ে যাচ্ছে কী করে, এ প্রশ্নও আর কেউ তুলছে না। গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত খসড়া আইনগুলিকে বিশেষ ভাবে আলোচনা করার জন্য বিধায়কদের নিয়ে তৈরি ‘সিলেক্ট কমিটি’-র কাছে পাঠানোই দস্তুর। কিন্তু গত বছর একটি বিলও সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়নি। যদিও শালিমার ওয়ার্কস, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল-সহ বেশ কিছু সংস্থার বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষণ (অডিট) রিপোর্ট পেশ হয়েছিল, তা নিয়েই বা কতটুকু আলোচনা হয়েছে? পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ওয়েবসাইট থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বছর বিধানসভার তিনটি অধিবেশন মিলিয়ে পনেরোটি কর্মদিবস ছিল, অধিবেশনের মোট দিনের সংখ্যা উনিশ। পনেরো দিনে পঁয়ত্রিশটি মৌখিক প্রশ্ন অনুমোদন করা হয়েছিল, প্রশ্নগুলি করেছিলেন মোট তেরো জন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন বিজেপি বিধায়ক, বাকিরা শাসক দল তৃণমূলের। এই করুণ চিত্র অনেকটাই গত বছর প্রধান বিরোধী দল বিজেপির এক দীর্ঘ সময় বিধানসভা অধিবেশন বয়কট করার ফল। এই বছর দু’টি অধিবেশনে প্রশ্নের সংখ্যা দেড়শো ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, অল্প কয়েক জন বিধায়কই অধিকাংশ প্রশ্ন করছেন, এবং তাঁরা অধিকাংশই শাসক দলের। বিধানসভার আলোচনার এই অসারতার অর্থ, গণমাধ্যমে ও জনপরিসরে তথ্য ও আলোচনার বিশেষ অভাব। এর ফলে সরকারের কাজের মূল্যায়ন আরও কঠিন হচ্ছে নাগরিকের কাছে।

Advertisement

সব মিলিয়ে এ যেন গণতন্ত্রের ব্যঙ্গচিত্র। ভোটের লড়াই যত তীব্র, হিংস্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার যা প্রধান লক্ষ্য, দায়বদ্ধ, তৎপর এবং স্বচ্ছ প্রশাসন— সে সব ততই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। প্রবীণ বিধায়করা মনে করতে পারেন না, অতীতে এই ভাবে কোনও রকম আলোচনা ছাড়া রাজ্য বাজেট পাশ হয়েছে কি না। যা ছিল অকল্পনীয়, এখন তা-ই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আলোচনাহীনতার এই ধারা কেন্দ্র থেকে রাজ্যে, রাজ্য থেকে স্থানীয় স্বশাসন, অর্থাৎ পঞ্চায়েতে বয়ে চলেছে। গ্রামসভায় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্থানীয় সমস্যার সমাধান, সকলের পরামর্শে উন্নয়নের পরিকল্পনা, গণতন্ত্রকে ক্ষমতাসীনের শাসনব্যবস্থা থেকে জনসাধারণের জীবনশৈলী করে তোলা— সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে বিধৃত সেই আদর্শ এখন তামাদি হতে বসেছে।

পরিস্থিতি আরও দুর্ভাগ্যজনক এই জন্য যে, মতের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাধানের দক্ষতা যে রাজনীতিতে অপরিহার্য, বিরুদ্ধ মতকে সম্মান করা, বিরোধীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে রাজনীতিকদের পেশাদারিত্বের পরিচয়, সে বোধ আজ সর্ব স্তরে প্রবল ক্ষয়িষ্ণু। গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে অবিচ্ছিন্ন ভোটযুদ্ধ—একটা যুদ্ধ শেষ হলেই ফের চলে প্রস্তুতি। সংসদ, বিধানসভাও নিরন্তর বাক্‌যুদ্ধের মঞ্চ হয়ে উঠেছে, চিৎকৃত স্লোগান, গালাগালি ডুবিয়ে দিচ্ছে আলোচনাকে। এই বিতর্ক-বিমুখতা এক অশনিসঙ্কেত। ‘আলোচনা মানে সময় নষ্ট’ এবং ‘নির্বাচিত নেতা সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান’— এমন ধারণা থেকেই উদ্ভব ফ্যাসিবাদের। নিরন্তর শক্তিপ্রদর্শন, অকারণ হিংস্রতা এবং ভীতিপ্রদর্শনের এই সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জমিকে ক্রমশ গ্রাস করছে, সাধারণ মানুষের নাগরিক সত্তাকে সঙ্কীর্ণ করে আনছে কোনও এক দলীয় সমর্থকের পরিচয়ে। বিধানসভার বিতর্কহীনতা তারই অশনিসঙ্কেত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন