Valentine’s Day

কাঞ্চনরঙ্গ

ভালবাসা এবং বাজারের সম্পর্ক নতুন নয়। অনুরাগ জানানোর জন্য উপহার দেওয়ার রীতি তো কোন সুদূর অতীত থেকেই চলে এসেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:০২
Share:

১৪ ফেব্রুয়ারি ‘কাউ হাগ’ ব্রত পালনের সুযোগ তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেল। ফাইল ছবি।

ভারতবাসীর কপাল মন্দ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘কাউ হাগ’ ব্রত পালনের সুযোগ তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেল। ‘ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আনন্দ’ বিবর্ধনের এমন একটি প্রতিশ্রুতি নিশি না পোহাতে স্রেফ জুমলায় পর্যবসিত হল, গোমাতার সন্তানদের অচ্ছে দিন এল না, জননী নিশ্চয়ই নীরবে অশ্রুপাত করছেন। তবে গোমাতায় যাঁদের ভক্তি নেই, তাঁরা যদি আজই নিজের নিজের ভালবাসার মানুষকে আলিঙ্গন করতে চান, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন অপ্রসন্ন হবেন না, কারণ তাঁর নামে নামাঙ্কিত এই সপ্তাহে আজকের তারিখটিই আলিঙ্গনের জন্য নির্ধারিত। শাস্ত্রমতে ভ্যালেন্টাইন’স ডে হল সপ্তাহব্যাপী এক দীর্ঘ উৎসবের শেষ অঙ্ক। ভালবাসা উদ্‌যাপনের সেই নির্ঘণ্ট শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি। সেটি ছিল গোলাপের দিন বা রোজ় ডে। তার পরে একে একে অতিক্রান্ত হল প্রোপোজ় ডে অর্থাৎ প্রেমের কথা জানানোর দিন; চকলেট দিবস— ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন; টেডি দিবস অর্থাৎ ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের সুকোমল টেডি বেয়ার উপহার দেওয়ার পরম লগ্ন; প্রমিস ডে: চিরকাল সঙ্গে থাকবার প্রতিশ্রুতি ঘোষণার মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ ‘হাগ ডে’ সেরে এবং আগামী কাল চুম্বন দিবসের পালা চুকিয়ে অবশেষে মঙ্গলবার যাত্রীরা পৌঁছবেন প্রেমপথের শেষ স্টেশনে। বেচারা পশুকল্যাণ বোর্ড এবং তস্য উপদেষ্টামণ্ডলী, এত কিছু তাঁদের জানবার কথা নয়, তাঁরা কেবল ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ শুনেছেন, অতএব ওই দিনটিকে গরু খোঁজার জন্য বরাদ্দ করে ভেবেছিলেন, বিজাতীয় সংস্কৃতির মোহজাল ছিন্ন করে স্বদেশি জাগরণের পবিত্র কর্তব্য পালনে অনেক দূর এগিয়ে গেলেন!

Advertisement

তবে কিনা, এই উদ্ভট এবং নির্বোধ অপপ্রয়াসটি প্রত্যাহার করিয়ে পশুকল্যাণ বোর্ডের মাথার উপরে বিরাজমান ‘কম্পিটেন্ট অথরিটি’ কেবল বহু ভক্তজনকে গোমাতার লাথি ও গুঁতো থেকে বাঁচালেন না, বড় রকমের নিষ্ফলতার হাত থেকেও নিজেদের রক্ষা করলেন। স্বদেশি ছাঁচের ভক্তি দিয়ে বিদেশি মডেলের ভালবাসা উদ্‌যাপনকে দমন করার উদগ্র বাসনা যত মহতীই হোক না কেন, তা চরিতার্থ করা অ-সম্ভব। তার কারণ, এই উদ্‌যাপন আদৌ ভালবাসার নয়, বাজারের। সমস্ত চিন্তাশক্তিকে গোষ্পদে সমর্পণ না করে ঈষৎ কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই উৎসব ভালবাসার নয়, বাজারের। ভালবাসা সেই বাজারের কাঁচামাল। এটা কোনও অর্থহীন সমাপতন নয় যে, এ দেশে ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদ্‌যাপনের আড়ম্বর জমে উঠেছে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষপর্ব থেকে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এবং বিদেশি বাজার থেকে মোটের উপর বিচ্ছিন্ন ভারতীয় অর্থনীতির দরজা-জানলাগুলি সেই দশকেই খুলতে শুরু করেছিল, ক্রেতারা স্বাধীন ভাবে আপন ইচ্ছা পূরণের সুযোগ পেয়েছিলেন। দেখতে দেখতে তার প্রভাব পড়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে— ঘরে ও বাইরে, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে, প্রয়োজনে ও বিনোদনে, সমস্ত পরিসরে মুক্ত বাজার তার বিপুল থেকে বিপুলতর সম্ভার নিয়ে মানুষের চিন্তায় চেতনায় নিজের দাপট উত্তরোত্তর প্রসারিত করে চলে। ভালবাসাই বা তার বাইরে থাকবে কেন?

ভালবাসা এবং বাজারের সম্পর্ক নতুন নয়। অনুরাগ জানানোর জন্য উপহার দেওয়ার রীতি তো কোন সুদূর অতীত থেকেই চলে এসেছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনিতে প্রেমাস্পদকে ভালবাসা নিবেদনের অনুষঙ্গটি প্রথমাবধি বহাল ছিল। বিশেষত, সঙ্গোপন, রহস্যময় প্রেম নিবেদনের জন্য প্রেমপত্র, গোলাপ, টেডি বেয়ার থেকে শুরু করে আরও কত রকমের উপহারের কথাই না প্রেমিক মানুষ ভেবেছে! অতএব নয়া বাজারের লীলায় উপহার দেওয়ার রীতি ষোড়শোপচারে উৎসারিত হয়ে উঠবে, এর থেকে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, সুতরাং ভালবাসার অগণন উপহার থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হল বিশ্বজোড়া হাটে ও বাজারে। এক দিনের উৎসবে সেই অনন্ত বিকিকিনি আঁটবে না, তাই সপ্তাহ জুড়ে উপহারের বাণিজ্য— গোলাপ কিংবা টেডি বেয়ার তো আছেই, প্রেম-সপ্তাহের অন্য দিনগুলিও কি সেই বাণিজ্যে শামিল নয়? ভালবাসার প্রস্তাব কি খালি হাতে দেওয়া যায়? কিংবা সারা জীবন সঙ্গী থাকবার প্রতিশ্রুতি? ক্রমে ক্রমে এই উৎসব সপ্তাহ ছাড়িয়ে দীর্ঘতর কাঞ্চনরঙ্গের রূপ নিলেও অবাক হওয়ার কোনও কারণ থাকবে না। নরেন্দ্র মোদী যে বছর দিল্লির তখ্‌তে আসীন হন, সেই ২০১৪ সালেই ভারতে ভ্যালেন্টাইন-বাজারের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২২০০০ কোটি টাকা। এই মহাশক্তিকে আটকানো গোমাতার সাধ্যে কুলোবে কি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন