এই মুহূর্তে ভারত একটি পরিবেশ সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দিল্লির বিপুল বায়ুদূষণ নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা হচ্ছে, সে তুলনায় অন্যান্য শহরের অবস্থা অনালোচিত। কিন্তু, পরিস্থিতি সর্বত্রই কম-বেশি খারাপ। যেমন, দিনকয়েক আগেই একিউআই সূচকের মাপে কলকাতায় দূষণের মাত্রা ছাপিয়ে গেল দিল্লিকেও। পরিবেশের প্রশ্নটি আক্ষরিক অর্থেই এক সভ্যতার সঙ্কট। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সময়পর্ব থেকেই শুরু হয়েছে দু’টি ঘটনা— এক, ধনতন্ত্রের জয়যাত্রা; এবং দুই, পরিবেশের ক্রম অবনতি। স্পষ্টতই, এ দু’টি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই ক্রমবর্ধমান কলকারখানা আসলে এই সমস্যার প্রকাশমাত্র, মূল কারণ নয়। কারণটি নিহিত আছে ধনতন্ত্রের চালিকাশক্তিতে— যার নাম, চাহিদা। সমানেই বেড়ে চলা, বাড়তে থাকা, চাহিদা। মানুষের চাহিদা সীমিত হয়ে গেলে, এবং অল্প উৎপাদনেই তা পূরণ করা সম্ভব হলে থমকে যেত ধনতন্ত্রের গতি। ফলে, চাহিদা বজায় রাখা, এবং নিত্যনতুন পথে তাকে বাড়িয়ে চলা ধনতন্ত্রের সাফল্যের শর্ত। আর, সেই চাহিদা দ্বিবিধ পথে দূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে— উৎপাদন ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া দূষণ, এবং পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি হওয়া দূষণ। কলকারখানা যত বেড়েছে, বাণিজ্যর জোগানশৃঙ্খল যত বৈশ্বিক হয়েছে, ততই চাহিদা বেড়েছে জ্বালানির, ততই তৈরি হয়েছে অধিকতর উৎপাদন-বর্জ্য। আবার, মানুষ যত গাড়ি চেপেছে, যত বেশি বাতানুকূল যন্ত্র ব্যবহার করেছে, এমনকি যত দ্রুত পাল্টে ফেলেছে জামাকাপড় থেকে মোবাইল ফোন, সবই বাড়িয়ে চলেছে পৃথিবীর উপরে দূষণের বোঝা। দূষণ এবং পরিবেশের ক্ষতিকে তাই ধনতন্ত্রের অগ্রগতির পাশাপাশি দেখা ছাড়া উপায় নেই।
প্রশ্ন হল, গোটা দুনিয়া যদি ধনতন্ত্রের বদলে অন্য কোনও উৎপাদন ব্যবস্থায় চালিত হত, তা হলে কি এই বিপদ এড়ানো সম্ভব হত? এক কালে ধনতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থা হিসাবে সুপরিচিত সমাজতন্ত্রের উদাহরণ নিলে বলতে হয়, সে সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। প্রকৃত সমাধানটি নিহিত আছে ধনতন্ত্রের চলনের মধ্যেই— আরও স্পষ্ট করে বললে, দায়িত্বশীল ধনতন্ত্রে। সেখানে দূষণের এক্সটার্নালিটি বা অতিক্রিয়াকে উৎপাদন ব্যয় বা ক্রয়মূল্যের অন্তর্গত করা জরুরি। কার্বন করের মাধ্যমে দুনিয়া সে পথে ইতিমধ্যেই হাঁটতে আরম্ভ করেছে। যে ক্ষেত্রে দূষণটি সহজে ‘চোখে পড়ে’, সে ক্ষেত্রে সচেতনতার মাত্রাও তুলনায় বেশি। কিন্তু, যেখানে দূষণ চোখ এড়িয়ে যায়? যেমন, একবিংশ শতকে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সময়কালে যা বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার চালিকাশক্তি, সেই তথ্যের ক্ষেত্রে দূষণের মাত্রাটি অনেকেরই অজানা। কম্পিউটারে বা স্মার্টফোনে তথ্যের আদানপ্রদানের যেহেতু কোনও আপাত-বাহ্যিক রূপ নেই, তাই অনেকেই ধরে নেন যে, তার কোনও দূষণও নেই। বাস্তবে অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তির শক্তির চাহিদা বিপুল। প্রতিনিয়ত যে বিপুল তথ্য উৎপন্ন হচ্ছে, তাকে ধরে রাখার জন্য অসীম ক্ষমতাবান সার্ভার ও তথ্য-গুদাম চাই, সেগুলির বিদ্যুৎ-চাহিদা অকল্পনীয়। এমন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপরে বিশেষ কর আরোপ করা বিধেয়, যা শেষ পর্যন্ত গ্রাহককে বহন করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতিকে যত ক্ষণ অবধি গ্রাহকের কাছে বর্ধিত আর্থিক মূল্য হিসাবে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে, তত ক্ষণ সচেতনতা বাড়া মুশকিল— সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশা করা মুশকিলতর।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে