Sanchar Saathi

কৈফিয়ত

নাগরিকের ফোনে তাঁর সম্মতির তোয়াক্কা না করেই এমন একটি অ্যাপ ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কি না, যার তথ্যের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে?

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫১
Share:

শেষ পর্যন্ত সঞ্চার সাথি নামক অ্যাপটিকে প্রতিটি মোবাইল ফোনে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটল কেন্দ্রীয় সরকার। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া এই জমানায় বিরল ঘটনা, তাতে সন্দেহ নেই। দিনকয়েক আগে জানা গিয়েছিল, সরকার মোবাইল নির্মাতা সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে যে, এই সরকারি অ্যাপটি প্রতিটি ফোনে প্রিইনস্টল করতে হবে। চরম নিন্দকও এ কথা মানতে বাধ্য হবে যে, কেন্দ্রীয় সরকার যা-ই করে, তা-ই নিতান্ত জনস্বার্থে করে। কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া জানিয়েছিলেন, এই সিদ্ধান্তটিও মানুষের স্বার্থেই— বহু লোক এমন কার্যকর অ্যাপের কথা জানেনই না, তাই অ্যাপটি তাঁদের নাগালে আনার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। তবে, মন্ত্রিবর কয়েকটি কথা বলেননি। যেমন, মোবাইল সংস্থাগুলিকে এমন জনস্বার্থ-সংক্রান্ত নির্দেশ দেওয়ার সংবাদটি সরকার জানাল না কেন, তা একটি সংবাদ সংস্থার তদন্তমূলক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল কেন? অথবা, যে সরকার প্রতি বছর বিজ্ঞাপন বাবদ কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে, তারা এই অ্যাপটির বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবল না কেন? অথবা, নাগরিকের ফোনে তাঁর সম্মতির তোয়াক্কা না করেই এমন একটি অ্যাপ ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কি না, যার তথ্যের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে?

কেউ বলতেই পারেন যে, সরকার যখন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেই নিয়েছে, তখন আর এ নিয়ে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন কী? সরকার একটি ভুল সিদ্ধান্ত করেছিল, অল্প দিনের মধ্যে ভুল বুঝে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, ফলে নাগরিকেরও আর সে কথা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই— এই সামাজিক শিষ্টতা-বাচক অবস্থানটিতে কয়েকটি গোলমালের আশঙ্কা নিহিত থাকে। প্রথমত, আজ বিস্তর হইচই হওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করেছে বলেই কাল ফের অন্য কোনও ভাবে, আরও নিঃশব্দে, এই কাজটি করা হবে না, সে নিশ্চয়তা আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। বিশেষত, গত কয়েক বছরে সরকার যে ভঙ্গিতে বারে বারেই নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকার পেতে চেয়েছে, তাতে এই আশঙ্কাটিকে অমূলক বলা মুশকিল। দ্বিতীয় কথা হল, ভবিষ্যতে যদি সরকার এই চেষ্টা না-ও করে, এ বারের চেষ্টাটিকে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে দেখতেই হবে। নাগরিকের সম্মতি না নিয়ে, আইনসভায় আলোচনা না করে, এমনকি কোনও ভাবে কাউকে জানতে না দিয়ে সরকার প্রত্যেকের ফোনে একটি অ্যাপ ইনস্টল করতে চেয়েছিল, এই ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুতর নাগরিক অধিকার-ভঙ্গ। গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রচেষ্টার জন্য সরকারের কাছে কৈফিয়ত দাবি করা নাগরিকের অধিকার। সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে বলেই নাগরিককেও নিজের অধিকার স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিতে হবে, এমন দাবি করা চলে না।

এ প্রসঙ্গে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন করা প্রয়োজন— স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে সরকার কি আদৌ ঢুকতে পারে? কোনও উদারবাদী গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রশ্নের উত্তর, দ্ব্যর্থহীন ভাবে, ‘না’। কিন্তু, নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করা সর্বাধিপত্যকামী শাসকের চিরন্তন চাহিদা। সেই নিয়ন্ত্রণের শ্রেষ্ঠ পথ তথ্য। কে কার সঙ্গে কথা বলছেন, কে কাকে অর্থসাহায্য করছেন, কে কখন কোথায় যাচ্ছেন, প্রতিটি তথ্যই সেই নাগরিকের জীবনের মানচিত্রের এক-একটি বিন্দু— সর্বাধিপত্যকামী শাসক সেই বিন্দুগুলিকে সংযুক্ত করে নাগরিকের জীবনের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ মেপে নিতে চায়। যে নাগরিকের জীবনের মানচিত্র রাষ্ট্রের চোখে বিপজ্জনক বোধ হবে, তাঁকে শায়েস্তা করার হরেক অস্ত্র রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। ‘বিগ ব্রাদার’ নজরদারি করেই থাকে— আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তার জন্য শুধু ফোনের তথ্য হাতে থাকলেই যথেষ্ট। এই কারণেই, সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত পিছু হটলেও কৈফিয়ত দাবি করা থামালে নাগরিকেরই ক্ষতি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন