ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া, বাক্যটি কি প্রকৃতই শূন্যগর্ভ? পশ্চিমবঙ্গের সমাজকেই তার প্রমাণ দিতে হবে। ইতিমধ্যে গত ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর দিন দু’টি একযোগে রাজ্যের বিপদকে এক ধাক্কায় অনেক বাড়িয়ে দিল— দেশভাগ-জর্জরিত রাজ্যটি আবার নতুন করে হিন্দুমুসলমান চর্চায় আড়াআড়ি বিভক্ত। একে তো ৬ তারিখকে লক্ষ্য করে আগে থেকেই চলছিল সদ্য-প্রাক্তন তৃণমূল নেতা হুমায়ুন কবীরের ‘বাবরি মসজিদ তৈরি’র হুঙ্কার ও তোড়জোড়। তার পর ভারত ইতিহাসের সেই কুখ্যাত দিনটিতে মুর্শিদাবাদের ওই মসজিদ তৈরিকে কেন্দ্র করে চলল ব্যাপক প্রচার। অন্য দিকে, ৭ তারিখ কলকাতার ময়দানে পাঁচ লক্ষ মানুষের গীতাপাঠ আয়োজিত হল— এ রাজ্যকে হিন্দুত্ব প্রচারের মাঠ বানিয়ে ফেলার লক্ষ্যে বড় পদক্ষেপ। নানা ধর্মগুরু ও রাজ্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যে স্বয়ং রাজ্যপালও সে দিন গীতাপাঠমঞ্চে নেতৃত্ব দিলেন, সেটাই বলে দেয় এতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণোদনা কতখানি গভীর। বিজেপি এখন ধর্মীয় প্রচারের খেলার পরবর্তী ধাপে— হিন্দু ভোটের বৃহদংশ নিজের দিকে টেনে মুসলমান ভোটের ভাগাভাগি করার পর্বে। অর্থাৎ হুমায়ুন কবীরের নিজস্ব ইসলামি কর্মসূচি ও বিজেপির সরকারি হিন্দুত্ব প্রচার এখন সরাসরি পরস্পরের পরিপূরক। ভোট আসার কয়েক মাস আগে যে সুযোগ বুঝে এই ভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রচারের সুরটি দুই দিকে তারসপ্তকে বাঁধা হল, এবং ধর্মাবেগে ভর করে ভোটের হিসাব পাল্টানোর প্রয়াস শুরু হল, তাতে কার কতখানি সুবিধা, সাদা চোখেই দেখা যায়— শুভেন্দু অধিকারীরা তা গোপন রাখার চেষ্টাও করছেন না। সংসদেও বন্দে মাতরম্ চর্চার নামে চলছে হিন্দুমুসলমান বিদ্বেষের বপন, সেচন, কর্ষণ। আর রাজ্যের নাগরিক সমাজ— বিশেষত নগরবাসী সমাজ? চিরকালই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সবচেয়ে বড় ব্যাপারি এই সমাজ এখন প্রতি সন্ধেয় তারসপ্তকে গলা চড়িয়ে হিন্দুমুসলমান তরজায় মত্ত।
দুর্ভাগ্যক্রমে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস আপাতভাবে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতার কথা বললেও এই বিদ্বেষ-কারবারে তাদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। জানা কথা যে, সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের পাশে থাকার নামে গোঁড়া ধর্মরাজনীতির কুকারবারি মানুষেরও মঞ্চ হয়ে উঠেছে এই দল। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী শেষ অবধি শাসক দল থেকে হুমায়ুন কবীরকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে নিলম্বিত করলেন ঠিকই, কিন্তু তা কি বহুবিলম্বিত নয়? এর আগেও বিজেপি দলে থাকার সময়ে কিংবা বিজেপি ছেড়ে আসার পরও ইনি ন্যক্কারজনক কথা বলেছেন। তা কি মুখ্যমন্ত্রীর অজানা ছিল? বিপদ পেকে ওঠার আগে যদি তা রোধ করা না হয়, তবে কি বিপদ পাকার জন্যই ছিল অপেক্ষা! একই ভাবে গীতাপাঠ সূত্রে হিন্দুত্বপ্রচারের বিরুদ্ধেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া কঠিন, কেননা কেবল দিঘার বিপুলাকার জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের কৃতিত্বই তো নয়, পাড়ায় পাড়ায় মন্দির বিস্তারেও এখন তাঁর দল সিদ্ধহস্ত। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সব দলেরই এত দিনে জানা উচিত প্রতিযোগিতামূলক ‘নরম ধর্মরাজনীতি’র বিপদ।
রাজ্যের উন্মার্গগামী রাজনীতির এই ধর্মফাঁদ কাটাতে পারেন একমাত্র সাধারণ মানুষ। তাঁদের প্রকৃত উন্নয়ন যে আরও একটি মসজিদ নির্মাণের মুখাপেক্ষী নয়, কিংবা সদলবলে গীতা পাঠের উপর নির্ভরশীল নয়— সম্ভবত এ সত্য রাজ্যবাসী জানেন, নগরজীবনের দীপশিখালোকবৃত্তের বাইরের বাসিন্দারা জানেন। পশ্চিমবঙ্গের সামূহিক ঐতিহাসিক স্মৃতির কারণেই হয়তো তাঁরা এ কথা আরও বেশি করে জানেন। ফলে, আশা করা যায়, গোড়ার বাক্যটি সমগ্রত শূন্যগর্ভ নয়— নেতারা যে রাজনীতি করছেন, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণও সেই রাজনীতিতেই ভাসবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। এই রাজ্যের মানুষ নিজেদের আর্থসামাজিক লাভক্ষতির হিসাব কষেই ভোট দেবেন, মসজিদের ইটবহনের বা মন্দিরদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় প্রীত বা ক্রীত হয়ে নয়।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে