West Bengal Assembly Election 2021

প্রজ্বলিত

পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিকরা যতই রাজ্যকে টানিয়া নামাইতে চাহেন, সাধারণ মানুষ যেন ততই স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেন যে, তাঁহারা হার মানিবেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:৩২
Share:

যে ২০২১ সালটি তাহার শেষ আহ্নিক আবর্তটি আজ সম্পূর্ণ করিতে চলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গের নিকট তাহার একটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এই বৎসরটিতে এই রাজ্যকে এক বড় দায় বহন করিতে হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত যাহা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে পশ্চিমবঙ্গবাসীর গর্বিত বোধ করিবার কিছু কারণ অবশ্যই আছে। বিধানসভা নির্বাচনের ঘূর্ণিপাকে এই রাজ্য বিদ্বেষ-বিভেদের ফাঁদে নিজেকে ডুবাইয়া দেয় নাই, সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের যে চক্র সমগ্র দেশে শাখাপ্রশাখা বিস্তারে ক্রমবর্ধমান, তাহাকে কার্যত একার জোরে প্রতিহত করিয়াছে। সেই চক্র পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিল, বাঙালি গ্রস্ত হয় নাই। কলিকাতা-বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ব ভারতে সেই চক্র নিজের জমি শক্ত করিবার স্বপ্ন দেখিয়াছিল, বাঙালি তাহার স্বপ্ন পূর্ণ হইতে দেয় নাই। স্বভাবতই গোটা দেশের ও বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষের অভিবাদন ধ্বনিত হইয়াছে পশ্চিমবঙ্গকে লক্ষ করিয়া। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক দাপটের সামনে নিজেকে সংহত রাখিবার কাজটি সহজ ছিল না। স্বার্থসন্ধানী নেতাদের বিদ্বেষী ইন্ধনের সামনে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান নিজেদের মধ্যে যুযুধান না হইয়া উঠা সহজ ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় দফার শাসন কতখানি সফল হইবে, এখনই তাহা বলা কঠিন, বিশেষত গত কয়েক মাসের মধ্যেই যখন কিছু প্রশাসনিক নীতি জনমানসে দুশ্চিন্তা উদ্রেক করিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রমাণ করিতে হইবে যে, বাংলার মানুষ তাঁহার প্রতি উপর্যুপরি তিন বার আস্থা জ্ঞাপন করিয়া ঠিক কাজ করিয়াছেন কি না। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও একটি বিষয়ে সন্দেহ নাই। এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি পশ্চিমবঙ্গকে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিয়াছেন। বাঙালিকে নিজের বিশেষত্ব প্রমাণের উপযোগী বাতাবরণ দিতে সক্ষম হইয়াছেন।

Advertisement

বাঙালির বিশেষত্বের কথাই যদি উঠে, তবে প্রদীপের নীচে অন্ধকারটির কথাও উঠিবে। এক দিক দিয়া পশ্চিমবঙ্গ যেমন প্রমাণ করিয়াছে, তাহার বিশিষ্টতা আজও অবিসংবাদিত, সে আজও যথেষ্ট প্রগতিশীল, যথেষ্ট অসাম্প্রদায়িক, যথেষ্ট জনস্বার্থমুখী— তেমনই সে ইহাও প্রতিষ্ঠা করিয়াছে যে, হিংসার উন্মাদনার নিরিখে এখনও সে আগের মতোই সিদ্ধহস্ত। ভোটের পরবর্তী পর্বে যে অশান্তি ও নৈরাজ্য দেখা গেল, যত রক্ত বহিল, তাহাই এই ‘বিশিষ্টতা’র প্রমাণ। সত্তরের দশক হইতে নব্বইয়ের দশক, এবং নন্দীগ্রাম-উত্তর পালাবদলের সংঘাতময় আবহ এই রাজ্য এখনও রক্ষা করিয়া চলিতেছে, হিংসার রাজনীতিকে প্রতি দিন পুষ্টতর করিতেছে। দলবদল সর্বত্রই হয়, কিন্তু তাহার যে নির্লজ্জ আতিশয্য ২০২১ সালে এই রাজ্যে ঘটিয়াছে, তাহাও আলাদা করিয়া লক্ষ করিবার মতো। রাজনীতির অনৈতিকতাই হউক, আর বিরোধীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনই হউক, পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড বাঙালির মাথা হেঁট করিয়া দেয়। কেহ বলিতেই পারেন, সদর্থক এবং নঞর্থক, দুই দিক দিয়াই ২০২১ সাল দেখিল, পশ্চিমবঙ্গ আছে পশ্চিমবঙ্গেই।

সমগ্র ছবি হইতে হয়তো বাহির হইয়া আসে একটি বিশিষ্ট ছাঁদ। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিকরা যতই রাজ্যকে টানিয়া নামাইতে চাহেন, সাধারণ মানুষ যেন ততই স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেন যে, তাঁহারা হার মানিবেন না। স্বার্থদ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, অনৈতিকতার কারবারে বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিরতি দেন না, অপর দিকে যখনই কঠিন পরিস্থিতি সামনে আসিয়া দাঁড়ায়, বাঙালি সমাজ বিভিন্ন ভাবে আশার উদ্ভাস তৈরি করিয়া চলে। নির্বাচনী ঋতুতে তাহার প্রমাণ মিলিয়াছে, কোভিড-মোকাবিলার দীর্ঘ দিনরজনীতেও তাহার স্বাক্ষর থাকিয়াছে। রেড ভলান্টিয়ার্স-এর মতো নাগরিক উদ্যোগ দেশের সর্বত্র দেখা যায় নাই, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যেও অন্যান্য রাজ্যে এত সংখ্যক মানুষ সরব হন নাই। হয়তো এইখানেই এক আশার বার্তার সন্ধান রাখিয়া যাইতেছে ২০২১।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন