Haryana Violence

ঘৃণার উপত্যকা

হরিয়ানার এই ঘটনাক্রমকে গোষ্পদে ‘নতুন ভারত’ দর্শন বলা যেতে পারে। নতুন মাত্রেই তা পুরাতনের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৩ ০৮:৪৭
Share:

অশান্ত হরিয়ানা। — ফাইল চিত্র।

তিন বছর আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ স্থির করেছিল, হরিয়ানার নুহ জেলায় হিন্দু ধর্মের পবিত্র ক্ষেত্রগুলির গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। এতে আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না কারও— ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধানসিদ্ধ, তার প্রসারে সচেষ্ট হওয়ার অধিকারও। তবে কিনা, নুহ জেলাটি একটি বিশেষ অর্থে অ-সাধারণ। হরিয়ানার মোট জনসংখ্যায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুপাত যেখানে মাত্র সাত শতাংশ, নুহ জেলায় সেই অনুপাতটি আশি শতাংশের সামান্য কম। এই জেলায় হিন্দু ধর্মের কিছু ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্র রয়েছে, তা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আবিষ্কার করেনি। শ্রাবণ মাসে স্থানীয় দু’টি মন্দিরে হিন্দু দর্শনার্থীরা চিরকালই আসতেন, কোনও অশান্তি ছাড়াই পুজো দিতেন। কিন্তু, উগ্র ধর্মপ্রসারকামী মাত্রেই জানেন যে, শক্তি প্রদর্শন না করলে, অস্ত্রের ঝনঝনানি না থাকলে ধর্মের ‘গৌরব পুনরুদ্ধার’ করা যায় না। ফলে, গত তিন বছর ধরে প্রথমে হরিয়ানার অন্য জেলা থেকে, পরে পার্শ্ববর্তী দু’টি রাজ্য থেকে মেওয়াট দর্শন যাত্রায় ভিড় বাড়তে থাকল। এ বার এক স্বঘোষিত গোরক্ষক— গত ফেব্রুয়ারিতে দুই মুসলমান ব্যক্তিকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে যাঁর বিরুদ্ধে— সমাজমাধ্যমে বিবিধ উস্কানি-সহ জানিয়ে রেখেছিলেন, তিনি স্বয়ং এ বারের যাত্রায় উপস্থিত থাকবেন। তার পরের চিত্রনাট্যটি অতি চেনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মিছিল গেল মসজিদের সামনে দিয়ে, অশান্তির প্ররোচনা তৈরি হল, মুসলমানরা আক্রমণ করলেন, হিন্দুরা ‘প্রতিরোধ’ করলেন। তিনটি জেলা জুড়ে বিপুল অশান্তি হল, পুড়ে গেল হাজার হাজার ঘর। দেখা গেল, মুসলমানদের ক্ষতি বহু গুণ বেশি।

Advertisement

হরিয়ানার এই ঘটনাক্রমকে গোষ্পদে ‘নতুন ভারত’ দর্শন বলা যেতে পারে। নতুন মাত্রেই তা পুরাতনের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়। ভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থলের সামনে উস্কানি দেওয়ার অভ্যাসটিই যেমন শতাব্দীপ্রাচীন, ভিন রাজ্য থেকে লোক নিয়ে আসা, সেই প্রথারও বয়স কয়েক দশক হল। এখন রামনবমীর মিছিল করতেও ভিন রাজ্য থেকে লোক আনা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জনপদে স্বভাবত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকত, রাজনীতির বিষ তাকে ভ্রাতৃঘাতী করে তোলে, তা-ও এ দেশ অভিজ্ঞতায় জানে। নুহ-এর ঘটনার পর হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য— পুলিশের পক্ষে সবার প্রাণরক্ষা করা সম্ভব নয়— সেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও নতুন নয়, এর অনুরণন একুশ বছর আগে অন্য এক মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের ব্যাখ্যায় পাওয়া সম্ভব। যা নতুন তা হল, রীতিমতো ঘোষণা করে অশান্তি তৈরি করা হল, কিন্তু প্রশাসন তাকে ঠেকানোর চেষ্টাই করল না; সাম্প্রদায়িক সংঘাতের অজুহাতে সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সম্পত্তির উপর বুলডোজ়ার চালানোর ব্যবস্থা করল। আপাতত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্ট। কিন্তু, প্রশাসন কী চায়, তা ইতিমধ্যে গ্রীষ্মরৌদ্রের মতো খরস্পষ্ট। শাসক রাজধর্ম বিস্মৃত হন, এ কথা ভারতে নতুন নয়— কিন্তু সেই বিস্মৃতিকে ঘোষিত ও গরিমান্বিত করার এই প্রকরণটি নতুন।

প্রশাসনের প্রকরণ যখন এত স্পষ্ট, সমাজ খুব দ্রুত পাল্টায়। নতুন ভারতের সমাজের সেই ছবি দেখা গেল দিনকয়েক আগে, জয়পুর-মুম্বই সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের কামরায়। এক আরপিএফ জওয়ান যাত্রীদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে তিন সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে হত্যা করল। সেই ঘটনার মর্মান্তিক ভিডিয়োয় জওয়ানের মুখে শোনা গিয়েছে দুই হিন্দু হৃদয়েশ্বরের নামে জয়ধ্বনি। বিভিন্ন মহল থেকে বারে বারেই জানানো হয়েছে যে, এই জওয়ান ‘লোন উলফ’, তার কোনও সংগঠন নেই, কোনও সঙ্গীও নেই। বাস্তব হল, সেই কারণেই ঘটনাটি আরও ভয়ঙ্কর। বিদ্বেষের বিষ এমন ভাবে প্রবেশ করেছে মানুষের মনে যে, হিংস্র হয়ে ওঠার জন্য তার আর কোনও সাংগঠনিক মদতেরও প্রয়োজন হচ্ছে না। গত দশ বছরে এই ভারতই গড়ে উঠেছে: এই ঘৃণার উপত্যকাই এখন আমাদের দেশ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন