ভারত এগিয়েছে, বন্ধুতা দেখাতে হবে পাকিস্তানকেও

সমস্যা হল দু’দেশেরই তথাকথিত জনমতের ভূমিকা এবং কট্টরবাদী জাতীয়তাবাদ। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষালসমস্যা হল দু’দেশেরই তথাকথিত জনমতের ভূমিকা এবং কট্টরবাদী জাতীয়তাবাদ। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share:

দু’দেশের মধ্যে যখন কূটনৈতিক মধ্যস্থতা হয় তখন চিরকালই সেই পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটা চিত্রনাট্য বা যৌথ স্ক্রিপ্ট থাকে।

Advertisement

ভারত এবং পাকিস্তান, দু’দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ইতিহাস পাঁচ দশক অতিক্রান্ত। এখনও কি দু’দেশের কূটনৈতিক মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে কোনও রকম চিত্রনাট্য আগাম রচনা করা সম্ভব নয়? আর এই খসড়া স্ক্রিপটিই হারিয়ে গিয়েছে বলে কি দু’দেশের ভিতর শান্ত্রিপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্লটটাই হারিয়ে গেল?

বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্তরের বৈঠক বাতিল হওয়ার মুখেও সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতীয় কূটনীতিতে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই। এত কিছুর পরেও পাকিস্তান আধা সামরিক বাহিনীর প্রধানদের বৈঠক ও অন্য যোগাযোগগুলি স্থগিত রাখবে এমনটা না-ও হতে পারে। গত মাসে উফা-য় দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীরা বৈঠক করে এই সব ফলো আপ বৈঠকগুলির কর্মসূচি ঠিক করেছিলেন। আসলে নরেন্দ্র মোদী ও নওয়াজ শরিফ দু’জনেই শীর্ষস্তরে বৈঠক করতে আগ্রহী। এত কাণ্ডের পরেও সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক শহরে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসলে অবাক হব না। এমনকী, জানুয়ারি মাসে সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদ যেতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী নরেন্দ্র মোদীও।

Advertisement

আসলে ভারত ও পাকিস্তান দু’পক্ষই খুব বেশি দিন এক জন আর এক জনকে ছেড়ে থাকতে পারে না। থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু তাপমাত্রাটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছনো যে উচিত নয় যেখানে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়, সেটা তো পরমাণু শক্তিধর দুই রাষ্ট্রেরই প্রধান জানেন।

আসলে সমস্যা হল দু’দেশেরই তথাকথিত জনমতের ভূমিকা এবং কট্টরবাদী জাতীয়তাবাদ। আজকের এই মিডিয়া প্রাধান্যযুক্ত সমাজব্যবস্থায় পলিটিক্স অফ পারসেপশন-ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণার রাজনীতির জন্যই মনমোহন সিংহ মনেপ্রাণে চাইলেও সনিয়া গাঁধীর কংগ্রেস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তানে যেতে দেয়নি।

পাকিস্তানে নানা কাজে পাঁচ বার গিয়েছি। প্রত্যেক বার দেখেছি তা লাহৌরেই হোক বা করাচি, কাশ্মীর নামক আবেগটি যুক্ত নানা ভাবে। হোটেলের নাম প্যারাডাইস কাশ্মীর। এমনকী, যে কোনও বাজার এলাকায় যান দেখতে পাবেন কাশ্মীর বিউটি পার্লার অথবা কাশ্মীর সেলুন লেখা নানা সাইনবোর্ড। পাকিস্তানের মনস্তত্বে কাশ্মীর ভাষণ ভাবে প্রোথিত। অর্ধেক কাশ্মীর পাকিস্তান পেয়েছে। পুরো পাওয়াটাই পাকিস্তানের আনফিনিশড অ্যাজেন্ডা বা অসমাপ্ত কর্মসূচি। ভারতীয়দের কাছেও কাশ্মীর সংবেদনশীল ধারণা। কিন্তু বিশাল এ দেশের নানা প্রান্তে নানা বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের কোনও বাঙালি বা তামিলনাড়ুর তামিল সম্প্রদায়ের কোনও মানুষের কাছে কাশ্মীর একটি রাজনৈতিক ইস্যু ঠিকই কিন্তু পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে এখনও কাশ্মীর যে ভাবে অগ্রাধিকার পায়, বহুত্ববাদী বিশাল হেটেরোজিনিয়াস ভারতের ক্ষেত্রে বোধহয় কাশ্মীর নামক বিষয়টির প্রকাশ ততটা উগ্র সংবেদনশীল নয়। পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিতে সামরিক শাসক ও মৌলবাদীরা এই বিষয়টাকে সম্ভবত আজও ইচ্ছে করে বাঁচিয়ে রাখেন।

এখন তো নওয়াজ শরিফ ঘর পোড়া গরু। এক বার কার্গিলের সময় তিনি হাত পুড়িয়েছেন। তাঁরই সেনাপ্রধান তো ছিলেন পারভেজ মুশারফ। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নওয়াজ শরিফ এই ভুল আর করতে চান না। তাই তিনিও সেনাবাহিনী আর মোল্লাতন্ত্রের মন জুগিয়েই চলছেন। তিনিও ভারত-পাক শান্তিপ্রক্রিয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্য আলবাৎ চান, কিন্তু প্রকাশ্যে বেশি প্রেম দেখিয়ে তিনি পাক জনমানসে ধারণার রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়তে চান না।

১৯৪৭ থেকে ’৬৫ সাল পর্যন্ত সময়ে দু’দেশই তাদের নানা সমস্যা সফলতার সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করেছে। দেশবিভাগের পরে পরেই সমস্যাও কিন্তু কম ছিল না। কাশ্মীর সীমান্তে শত সংঘর্ষের মধ্যেও দু’দেশের সীমান্ত সিল ছিল না। সিন্ধু নদীর জলবণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ’৬৫ ও ’৭১ সালের যুদ্ধের পর সীমান্ত সিল হল। দু’দেশেই সামরিক ব্যবস্থা আরও জোরদার হল। দু’দেশের ভিতরকার বাজারব্যবস্থা, পণ্য বিনিময় কার্যত বন্ধ হয়ে গেল। ছোট ছোট বিষয়গুলি নিয়েও জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেল। বাংলাদেশ ’৭১ সালে স্বাধীনতা পেল বটে, কিন্তু ভারত-পাক সম্পর্ক আরও জটিল হল। রাওয়ালপিন্ডি এর পর পরমাণু অস্ত্র গবেষণায় মন দিল। ’৮০ সালের শেষ ভাগে এসে দেখা গেল দু’দেশই পরমাণু শক্তিধর হতে মরীয়া আর সেনাতে ব্যয়ও দু’পক্ষই বাড়িয়ে চলেছে।

এত দিন হয়ে যাওয়ার পর এখন আমরা কী দেখছি! পাকিস্তান ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে কাশ্মীরে সন্ত্রাস জারি রেখে ভারতকে সমস্যায় ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার ভারতও পাকিস্তানের সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাতে গিয়ে পাকিস্তানকে বাণিজ্য করতে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শান্তি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে বাধ্য করতে পারেনি। তাই এখন দু’পক্ষই আসলে জানে না এই অচলাবস্থা কী ভাবে কাটানো সম্ভব।

অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংহ কিন্তু ‘ব্যাক চ্যানেল’ কূটনীতির মাধ্যমে অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে গত এক বছরে সরকারের অভিমুখ কী তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মূল প্রশ্নটি হল অস্থিরতা ও ধারাবাহিকতার অভাব। অনেক কূটনীতিক বলছেন, প্রথমেই শীর্ষস্তরে বৈঠক না করে নিচুস্তরে যুগ্মসচিব পর্যায়ে আলোচনাটা শুরু করা দরকার ছিল। তা না করে প্রথমেই মোদী-নওয়াজ পর্যায়ে আলোচনা করা মূর্খামি।

তবে এ হেন তীব্র সমস্যার মধ্যেও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী, এটাই আশার কথা। শুধু এই সরকার শান্তি প্রক্রিয়াকে বাস্তবের জমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর। পাকিস্তানকেও এই শান্তিপ্রক্রিয়ায় পূর্বশর্ত হিসাবে লিখিত ভাবে বন্ধুত্বের কিছু নমুনা দেখাতে হবে। দেয়ার ইজ নো ফ্রি লাঞ্চ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন