যাহার নুন

গত কয়েক বৎসরে রাজ্যের নাগরিক সমাজ শিক্ষামন্ত্রীকে বহু বার স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে জমিদারি এবং সরকারে খানিক ফারাক রহিয়াছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, রাজকোষে টাকা থাকিলেও সেই টাকার মালিকানা সরকার বা কোনও মন্ত্রীর নহে। টাকা জনগণের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১২
Share:

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবাব নাই। রাজ্যে অধুনা যে ‘যেমন খুশি চলো’-র যুগ চলিতেছে, সেই মাপকাঠিতেও শিক্ষামন্ত্রী অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মনে এক, মুখে আর এক— এই দ্বিচারিতায় যে তাঁহার বিশ্বাস নাই, তিনি আরও এক বার প্রমাণ করিলেন। এই দফায় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ নহে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। বলিলেন, দাবি পেশ না করিয়া তাঁহারা বরং নিজেদের দায়িত্ব বুঝিয়া লউন। পড়ানোয় মন দেওয়া? ছাত্রদরদি হওয়া? উঁহু, শিক্ষামন্ত্রীর মতে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্য ‘প্রচার’ করা প্রাথমিক শিক্ষকদের দায়িত্ব। রুলবুক খুঁজিয়া লাভ নাই, পার্থবাবু সেই নিয়মের নিগড়ে বাঁধা থাকিতে নারাজ। ইহা তাঁহার নিজস্ব নিয়ম। কেন? পার্থবাবু বিশদে বলেন নাই। বলিবার প্রয়োজনও নাই, উত্তরটি রাজ্যবাসী জানে— সরকার বেতন দিতেছে ইত্যাদি। রাজকোষ হইতে যখন মাসান্তে শিক্ষকদের মাহিনা আসে, তখন সেই সরকারের জয়গান করা শিক্ষকদের কর্তব্য বইকি। তিনি আক্ষেপ করিয়াছেন, বাম আমলে শিক্ষক সংগঠন সরকারের প্রতি যতখানি ‘কমিটেড’ ছিল, এখন আর তেমনটি নহে। এই আক্ষেপটি প্রকৃত প্রস্তাবে স্বীকারোক্তি— আজও, তাঁহাদের শাসনের সাড়ে সাত বৎসর অতিক্রান্ত হইবার পরও, রাজ্যের প্রতিটি অটোরিকশা হইতে লাল ঝান্ডা নামাইয়া ফেলিবার পরও, বাম আমলের পূর্ণগ্রাস আধিপত্য তাঁহাদের আয়ত্ত হয় নাই। বাসনা ছিল, ফলে আক্ষেপও আছে। পার্থবাবু ভিন্ন আর কেহ কি এমন ভাবে মনের কথা প্রকাশ করিবেন?

Advertisement

তবে, কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, ‘মন! মন! আপনার স্মৃতিশক্তি নাই, মন্ত্রিবর?’ গত কয়েক বৎসরে রাজ্যের নাগরিক সমাজ শিক্ষামন্ত্রীকে বহু বার স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে জমিদারি এবং সরকারে খানিক ফারাক রহিয়াছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, রাজকোষে টাকা থাকিলেও সেই টাকার মালিকানা সরকার বা কোনও মন্ত্রীর নহে। টাকা জনগণের। সরকার তাহার অছিমাত্র। অতএব, রাজকোষ হইতে শিক্ষকদের বেতন প্রদান করা হয় বলিয়াই তাঁহারা সরকারের আজ্ঞাবহ, এমন ধারণার মধ্যে অজ্ঞতার পাশাপাশি অনর্থক অহমিকাও বিপুল। কিন্তু, শিক্ষামন্ত্রী দৃশ্যত সেই কথাগুলি মনে রাখেন নাই, সেই তিরস্কার গায়ে মাখেন নাই। অতএব, তাঁহাকে আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, শিক্ষকদের বেতন যদিও তাঁহার সরকারের রাজকোষ হইতেই আসে, তবুও শিক্ষকরা তাঁহার অন্নদাস নহেন। স্কুলে তাঁহাদের হাজিরা বাড়াইবার কথা বলা, অথবা স্কুলছুট ছাত্রদের ফিরাইয়া আনিতে সচেষ্ট হইবার পরামর্শ দেওয়া অবশ্যই উচিত, কিন্তু সেখানেই থামিয়া যাওয়া উচিততর। বস্তুত, বামপন্থীদের নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁহারা যে রাজ্যটি পাইয়াছেন, সেখানে শিক্ষকরা অভ্যাসবশেই সরকারের অনুগত। দুর্জনে বলিবে, শিক্ষকনিয়োগের প্রক্রিয়াটি রাজনীতির জালে এমনই জড়াইয়া গিয়াছে যে বেচারা শিক্ষকদের আনুগত্য আরও না বাড়াইয়াও উপায় নাই। আরও কত আনুগত্য চাই তাঁহাদের? আরও কত প্রচার চাই? চলচ্চিত্র উৎসব হইতে দুর্গাপূজার ব্যানার, এই রাজ্যে সর্বত্র একটি মুখেরই প্রচার। রাজ্যের প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি বাসস্ট্যান্ড, প্রতিটি আলোকস্তম্ভের গায়ে লেখা, কাহার ‘অনুপ্রেরণা’য় রাজ্যটি চলিতেছে। আরও প্রচার চাই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন