প্রতীকী ছবি।
তা হলে কি ধরে নেব, কেউ পারে আর কেউ পারে না?
কারণ হবিবুর শেখ সেই সুতোটাই ধরিয়ে দিচ্ছেন, আর গুটিয়ে চলেছেন তাঁর অভিজ্ঞতার লাটাই— ‘‘তেমন খুন-খারাবি নয়, তবে দখলদারি নিতি গেলি লাঠালাঠি তো হবেই’’, নদিয়ার আড়ংঘাটার হবিবুর এখন মধ্য-সত্তর। ভাঁজ করা লুঙ্গি, আদুল গা হবিবুর বলছেন, ‘‘আপন গাঁ থেকে পালাতি হল ঠিকই তবে ফিরি তো এসিচি!’’ ক্রমান্বয়ে পলায়ন আর প্রত্যাবর্তন, ঢের দেখেছেন হবিবুর।
পঞ্চাশের দশক জুড়ে অন্তত বার পাঁচেক ফিরে আসা এবং চলে যাওয়ার পরে, এক সময়ে থিতিয়ে এসেছিল লড়াই। হবিবুরেরা এখন ফের ‘ইন্ডিয়ান ছিটিজেন’, ভারতেরই অধিবাসী। লাগোয়া দত্তপুলিয়া, শিলবেড়িয়া, শ্রীরামপুরের সংখ্যালঘু প্রধান গ্রামগুলির ইতিহাস বলছে, আদতে ভারতের অধিবাসী এই মানুষগুলো দেশভাগের পরে পা বাড়িয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। বলছেন, ‘‘আমাদের বলা হল, মোছলমানদের জন্য ওইটিই নাকি দ্যাশ।’’ বছর ঘোরার আগেই তাঁরা টের পেরেছিলেন, ধর্মের নামে দেশভাগ একটা হল বটে, তবে জমি জিরেত, নিজের ঘরগেরস্থালি, তার চেয়ে ঢের দামি। অতএব শুরু হল ফেরার পালা।
কিন্তু তত দিনে দখল হয়ে গিয়েছে জমি-ভিটে-পুকুর। লড়াইটা শুরু হল সেই থেকে। নিম্নবিত্ত এই মুসলিমদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগে পড়শি গাঁয়ের হিন্দুরা জবরদখল করে নিয়েছিল নদিয়ার মুসলিম প্রধান সেই সব প্রান্তিক গ্রামের সম্পত্তি। সেই তালিকায় রয়েছে চাপড়া, হাঁসখালি, তেহট্ট, করিমপুরে একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা বেশ কিছু গ্রাম। নদিয়া জেলা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার এবং হোম পলিটিক্যালের রিপোর্ট (যা স্টেট আর্কাইভে সযত্নে সংরক্ষিত) বলছে— পঞ্চাশের দশক জুড়ে একের পর এক সেই ‘লড়াই’-এ শেষতক নিজেদের ভিটে-মাটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন প্রত্যাবর্তন করা সেই মুসলিমরা।
দেশভাগের বছর ঘোরার আগেই, সীমান্ত বরাবর পঞ্জাবের বেশ কিছু গ্রামও একই ভাবে দেখেছিল দেশ ছেড়ে যাওয়া মুসলিমদের ফিরে আসতে। দাঙ্গা বিধস্ত গ্রাম শূন্য করে যাঁরা রাতারাতি পাকিস্তানের সীমান্ত ঘেঁষা গঞ্জের ক্যাম্পে ঠাঁই নিয়েছিলেন, হনন-আত্মহননের আঁচ থিতিয়ে যেতেই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিতান্তই আটপৌরে আবাদি, দিনমজুর, ঠিকা শ্রমিক— সেই সব মুসলিমেরা ফিরতে শুরু করেছিলেন গুরুদাসপুর, ফিরোজপুর, পাঠানকোটের পুরনো ভিটেয়। বিতাড়িত সেই সব সংখ্যালঘু মানুষকে নব্য দেশ (পাকিস্তান) যথাযথ ভরসা কিংবা মর্যাদা দিতে পারেনি, পুরনো ভিটেয় ফিরে তা কবুল করেছিলেন তাঁরা। হিন্দু কিংবা শিখ পড়শিদের কাছে জানিয়েছিলেন, ‘‘বর্ডার কো উস পার হামলোগ স্রিফ রিফিউজি থা।’’
ফিরোজপুর, অমৃতসরের সীমান্তের সেই সব গ্রামে পা দিলে এখনও তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, খোলা উঠোনে প্রশস্ত খাটিয়ায় বসে— দেশভাগের রক্তস্রোতে হারানো স্বজনের ভেসে যাওয়া থেকে গ্রাম ছেড়ে তাদের পলায়ন, তার পর এক সময়ে ফের সেই পুরনো আস্তানায় ফিরে আসার কথা, মালার মতো গেঁথে ফেলেন তাঁরা। ফিরোজপুরের আব্বাস মেহেরুজ্জুমান গভীর বিশ্বাস থেকে তাই বলছেন, ‘‘ইয়ে হামারা আব্বাজানকা মুলুক হ্যায় ভাই, পাকিস্তান ওয়াপাস কিঁউ যাঁউ!’’
এর পরেও অবশ্য প্রশ্ন একটা থেকে যায়। পঞ্জাব থেকে বাংলা, পূর্ব থেকে পশ্চিম, হবিবুর থেকে মেহেরুজ্জুমান— এই ফিরে আসা কি বাস্তবিকই ঠিকানা-হারা উদ্বাস্তুর ‘ডিসপ্লেসড ইমোশন’, নাকি ধর্মের ছায়ায় দেশভাগের পরে নিতান্ত সাধারণ এই আবাদি মানুষজনও বুঝতে পেরেছিলেন, রুজির সংস্থান ধর্মীয় অনুশাসনের চেয়ে ঢের বেশি দামি। আর, সে জন্যই নিম্নবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘর-হারা এই মানুষরা দলে দলে ফিরতে চেয়েছিলেন পুরনো আবাসে।
যা দেখে একটু শঙ্কিতই বুঝি হয়েছিল দিল্লি। ‘আফটার পার্টিশন’, প্রকাশক খোদ তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক, সরকারি প্রকাশনায় সেই পুস্তিকায় স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছিল— ‘the return of Muslims will impose a heavy strain upon the economy of the Dominion (India)’। সেই প্রত্যাবর্তনের স্রোতে বাঁধ দিতেই তাই চালু হল পারমিট ব্যবস্থা। তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রকের সেই পুস্তিকা বলছে— ‘Cognizant of this danger, the Govt. of India has recently introduced the permit system to check this movement’। নতুন দেশ, পাকিস্তানও তার নড়বড়ে আর্থিক কাঠামোয় উদ্বাস্তু স্রোত সামাল দিয়ে উঠতে পারছিল না। দিল্লি পারমিটের পাঁচিল তুলতে পাল্টা সে পথেই হাঁটল পাকিস্তানও।
তবে, লক্ষণীয় এটাই, পারমিটের বেড়া দেশের পশ্চিম প্রান্তে লাগু হলেও তার আগল খোলা সীমান্ত নিয়েই পড়ে থাকল পূর্ব সীমান্ত। সেখানে ঢিলেঢালা অবস্থাটা চলতেই থাকল।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে ফিরে আসতে ইচ্ছুক বহু মুসলিম, যাঁরা এ যাবত দেশের পশ্চিম সীমান্তে পারমিটের পাঁচিল টপকাতে পারছিলেন না, তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত ব্যবহারে তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ল।
অবাঙালি মুসলিমদের ক্ষেত্রে সে ছাড়পত্র খারিজ করে বসল সীমান্তরক্ষীরা। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত উজিয়ে ভারতে পা রাখতে গেলে তাঁদের কাছেও পারমিট চেয়ে বসল তারা। তাদের স্পষ্ট নিদান ছিল— সীমান্ত বদল করতে পারে এক মাত্র বাঙালি মুসলিমরা। তা কেন? প্রশ্নই তুলে বসল পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ‘ডন’। ১৯৫২ সালের ১০ অক্টোবর, একই দেশের দুই প্রান্তের দুই ভিন্ন রীতির সমালোচনা করে লিখল— ‘ভারতের কী কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি নেই? থাকলে, বাংলা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের পথে এমন বাধা কেন!’ পারমিটের কড়াকড়িটা শুরু হল এই সময় থেকেই।
দেশভাগের পর, অনায়াস চলাচলের পথে এই সময়েই মাথা তুলল একটা নতুন শব্দ, ‘অনুপ্রবেশ’। এই কড়াকড়ির আবহেই, ১৯৫২ সালে দিল্লি ঘোষণা করল, বাংলার পুব-পশ্চিমে পারাপারের ক্ষেত্রেও এ বার দাখিল করতে হবে বৈধ পাসপোর্ট।
শহুরে মধ্যবিত্তের সঙ্গে পাসপোর্টের একটা আবছা পরিচয় ছিল। বণিক মহলেও তার কদর ছিল খানিক। তা বলে, চাঁদপুর, গোয়ালন্দের স্টিমার কিংবা শিয়ালদহের গেদে প্যাসেঞ্জারে, সদ্য ছিঁড়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গে পাড়ি দিলেও যে তার প্রয়োজন হবে— এমনটা ভাবতেই পারেননি অনেকে। গ্রামীণ মানুষের কাছে সে ছিল এক্কেবারে অচেনা একটা শব্দ।
বেশি দিন অবশ্য সে অচেনা রইল না। শব্দটা ক্রমে সীমান্তের গাঁ-গঞ্জে চেনা লব্জ হয়ে উঠল।
সঙ্গে জুড়ে গেল আরও কয়েকটা শব্দ, ‘বর্ডার’, ‘রিফিউজি’, ‘স্মাগলার’। নদিয়া, খুলনা, কুষ্টিয়ার লোকগানে এমনকি সীমান্তের আটপৌরে যাত্রাপালাতে শুরু হয়ে গেল তাদের দেদার ব্যবহার— ‘আপন গাঁয়ে যাইতে হলি, আমার লাগি পাসপোট না পাইলে পুলিশ-বাবা চেয়ে বসে বড় নোট’
‘বর্ডার-পালানো বউ’ নিয়েও শুরু হল সামাজিক পালা। নাটক নিয়ে মেতে থাকা নদিয়ার প্রবীণ মানুষজনের কাছেও খোঁজ মিলেছে, অফিস কিংবা পাড়ার অনুষ্ঠানে এই ধরনের নাটকের বেশ কদর ছিল তখন। চলতি কথার অভিধানে জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি এই শব্দগুলোর সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে গিয়েছিল কিছু বেআইনি পেশার অনুষঙ্গ। পাসপোর্ট না থাকলেও যে নোটের বিনিময়ে পারাপার বৈধ হয়ে উঠতে পারে, লোকগানের কথা তারই খোঁজ দিয়েছে। সীমান্ত বা বর্ডার উজিয়ে চাল-পাট-নুন-ওষুধের যে অনায়াস চলাচল ছিল, তা-ও এখন চোরাচালানের চেহারা নিয়ে পারাপার হতে থাকল ‘স্মাগলিংয়ের’ মতো শব্দের আড়ালে।
তবে, দেশভাগের পাঁচ বছর পরে, পাসপোর্ট-ভিসার ঝকমারি শুরু হল বটে, নদিয়ার দর্শনা-বানপুর, চব্বিশ পরগনার বেনাপোলে কিঞ্চিৎ কড়াকড়িও হল, তবে তার বাইরে প্রহরাহীন সীমান্ত জুড়ে নদী-খাল-মাঠ পার হয়ে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, গরুর গাড়িতে কিংবা নৌকায়—নিরন্তর যাতায়াত বন্ধ হল না।
আড়ংঘাটার বরণবেড়িয়া গ্রামের বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘একটা পরিবারকে আড়াআড়ি ভাগ করে দিলে কি মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায় বাবা! এর সংসারের চচ্চড়ি ওর সংসারের কুচো মাছের ঝোলের আদানপ্রদানের মতো দু’বাংলার চলাচল চলতেই থাকল।’’