নোটবন্দি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

কষ্ট হচ্ছে? তবে নির্ঘাত দেশের ভাল হবে

আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: দু’সপ্তাহ খুব কম সময় নয়। চার ঘণ্টার নোটিসে শতকরা পঁচাশি ভাগ নগদ টাকা বাতিল করে দেওয়ার পরে দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। নতুন নোট বাজারে আসছে বটে, তবে তার গতিপ্রকৃতি দেখলে বলতে ইচ্ছে করে, দেবীর কচ্ছপে আগমন। লিখছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৫
Share:

দু’সপ্তাহ খুব কম সময় নয়। চার ঘণ্টার নোটিসে শতকরা পঁচাশি ভাগ নগদ টাকা বাতিল করে দেওয়ার পরে দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। নতুন নোট বাজারে আসছে বটে, তবে তার গতিপ্রকৃতি দেখলে বলতে ইচ্ছে করে, দেবীর কচ্ছপে আগমন। ব্যাঙ্কে ডাকঘরে এটিএমে ভিড়, রাস্তাঘাট ফাঁকা, হাটেবাজারে মন্দা, মিড ডে মিলে টানাটানি, চাষির হাতে বীজ সার কেনার টাকা নেই, ফসল কেনার খরিদ্দার নেই, দিন আনি দিন খাই মানুষের রোজগারপাতি নেই, অনেকেরই কাজ নেই, আরও অনেকের কাল বা পরশু কাজ হারানোর আশঙ্কা, অগণিত কপালে দুশ্চিন্তার রেখা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভ? অবরোধ? মিছিল? না, নেই। যেটুকু যা আছে, যেমন সুরাতে গত সপ্তাহের শেষে দেখা গেল, সেটা নিতান্তই ব্যতিক্রম, কিংবা দলীয় রাজনীতির লীলা— যথা দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিকদের তরিতরকারির মালা পরে প্রতিবাদের প্রদর্শনী।

Advertisement

ঘটনা হল, দেশের লোকে সাধারণ ভাবে এখনও বলছেন, সরকার কাজটা ঠিকই করেছে। সমস্যা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, হয়তো আরও হবে, গোটা ব্যাপারটা আর একটু ভেবেচিন্তে গুছিয়ে করা উচিত ছিল, কিন্তু দেশের ভাল করতে গেলে কিছু অসুবিধে, কিছুটা যন্ত্রণা মেনে নিতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী যখন জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেন, কালো টাকার কারবারিরা আমাকে গালাগালি দিচ্ছে, দেশবাসী কিন্তু আমার পাশে আছেন— তখন বলা যাবে না কথাটা ডাহা মিথ্যে। এবং দু’সপ্তাহ পরেও তিনি যে এই অহঙ্কার করতে পারছেন, সেটা বুঝিয়ে দেয়, প্রথম রাউন্ডে তিনি জয়ী।

এই সাফল্য বিপণনের, সাদা বাংলায় যাকে বলে মার্কেটিং। সফল বিপণন বড় সহজ ব্যাপার নয়। কোন বাজারে কোন পণ্যটি কী ভাবে হাজির করলে প্রথমেই ক্রেতাদের মনে ধরে যাবে, বিপণনবিশারদরা তা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভেবে চলেন, নানা রকম সমীক্ষা চালিয়ে এবং সেই সমীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে ক্রেতাদের নাড়িনক্ষত্র জানার, বোঝার চেষ্টা করেন, তার পর এক একটা প্রচারবার্তা নিয়ে বাজারে নামেন। সেই বার্তা নিশানায় লাগলে জয়ধ্বনি ওঠে, না লাগলে— হায়, এ কী সমাপন!

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী বাজারটিকে ধরেছেন ঠিক। দুর্নীতি দমনের বাজার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে একটা জোরদার হাওয়া আছে। শহরের নাগরিক সমাজ থেকে সেই হাওয়া চালু হয়েছিল, ক্রমশ তা বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়েছে। কিছু লোক বিপুল দুর্নীতি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে— এই ধারণা
বাকি লোকদের মনে জোরদার। ধারণাটা ভুল নয় বলেই তার জোর বেশি। কী ভাবে এই রাঘববোয়ালদের শায়েস্তা করে দুর্নীতির মোকাবিলা করা যায়, সে বিষয়ে মানুষের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, কিন্তু তাতে মোকাবিলার তাগিদটা কমে না, হয়তো বাড়ে। এই তাগিদটাকে পুঁজি করেই অণ্ণা হাজারে নামক মই বেয়ে অরবিন্দ কেজরীবালের উত্থান। সে পুঁজি তিনি নিজগুণে দ্রুত ক্ষইয়ে চলেছেন, তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, দলের ভবিষ্যৎও। ব্যক্তি তুচ্ছ, দল গৌণ, কিন্তু সাধারণ ভাবে দুর্নীতি নিয়ে সমাজের মনে অস্থিরতা বেড়েছে। মানুষ চাইছে, এ ব্যাপারে একটা কিছু হোক। বড় রকমের একটা কিছু।

৮ নভেম্বর রাত্রি আট ঘটিকায় প্রধানমন্ত্রী সেই চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে ঠিক কত দশমিক কত শতাংশ কালো টাকা ধরা পড়বে তার চুলচেরা হিসেব নিয়ে বহুজনের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁরা নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছেন যে, এটা একটা বড় রকমের ধাক্কা। এবং খুশি হয়েছেন। গত দু’সপ্তাহে ইতস্তত নানা খবর তাঁদের কানে এসেছে— কাঁড়ি কাঁড়ি নোট নিয়ে বিপাকে পড়া কেষ্টবিষ্টুদের মুখ চুন হয়ে যাওয়ার খবর, পুকুরে নর্দমায় জঞ্জালের স্তূপে ছেঁড়াখোঁড়া বাতিল নোট আবিষ্কারের খবর, এখানে ওখানে ‘আয়কর হানা’র খবর, যে সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অতিরিক্ত টাকা জমা পড়েছে সেগুলির আসন্ন তল্লাশির খবর। সত্যি সত্যিই কালো টাকার ক’জন মালিক কতটা সমস্যায় পড়লেন, মানুষ জানেন না। কিন্তু তা তাঁদের জানার দরকারও নেই, তাঁরা কেবল এইটুকু বুঝেছেন যে, যাদের যক্ষপুরীকে কেউ কখনও ছুঁতে পারেনি, তারাও আর নিরাপদ নয়। দিল্লীশ্বররা খুব হিসেব করে এই বোধটিতে তা দিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন এর পরে যে আবার কোনও খাঁড়া নেমে আসবে না, তেমন গ্যারান্টি তিনি দিচ্ছেন না— বস্তুত, বেনামী সম্পত্তি ধরতে অভিযান শুরু হল বলে। অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিত: যা হয়েছে তা কোনও বিচ্ছিন্ন লড়াই নয়, একটা বড় যুদ্ধের অঙ্গ, নানান ফ্রন্টে যুদ্ধটা চলবে। ধর্মযুদ্ধ।

এবং, মহাভারতের আপন দেশের মানুষ জানেন, ধর্মযুদ্ধে সৎ লোকদেরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতে হয়। বস্তুত, এই যে এত লোকের এত সমস্যা হচ্ছে, প্রতিদিন এত বড় বড় লাইন পড়ছে, এটাই আবার পরোক্ষে জানিয়ে দেয় যে একটা বড় রকমের কিছু ঘটছে— সত্যিই এত বড়, যা আগে কখনও হয়নি, দেশপ্রিয় পার্কে গত বছরের দুর্গার মতো।

আর একটা কথাও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। আমাদের দেশে কৃচ্ছ্রসাধনের মহিমা এখনও অপার। আমরা বিশ্বাস করি, পেটে কিল মেরে দেবতার পুজো না করলে দেবতা সন্তুষ্ট হন না। আগে তীর্থযাত্রায় অনেক কষ্ট ছিল, এখন অনেক তীর্থপথ সুগম হয়েছে, আর তাই বহু তীর্থযাত্রীর মনে ভারী দুঃখ— পুণ্যের অ্যাকাউন্টে বুঝি চার আনা কম জমা পড়ল! এমন দেশের মানুষ যদি কাঠফাটা রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে দুর্নীতিদমনের পুণ্য উপলব্ধি করেন, তাঁদের বিলিতি কেতায় ‘মর্ষকামী’ বলে গাল পাড়লে অন্যায় হবে।

অতএব, প্রধানমন্ত্রী এই ধারণাটি আপাতত বাজারে চালিয়ে দিতে পেরেছেন যে, তিনি যা করছেন দেশের ভালর জন্যে করছেন এবং সেই অভিযানে তাঁর পাশে থাকা প্রতিটি দেশপ্রেমী ভারতীয়ের কর্তব্য, সে জন্য কষ্ট ভোগ করাটা ওই পবিত্র কর্তব্যের অঙ্গ। দেশের ভাল মানে কী, দুর্নীতি দমনে সরকারি অভিযানের সাফল্য কী ভাবে মাপা যাবে, সেই অভিযানের জন্য দেশের মানুষকে কতটা মাসুল দিতে হবে, সাফল্য আর মাসুলের তুল্যমূল্য বিচার কোথায় দাঁড়াবে, সেই বিচারে শেষ পর্যন্ত দেশের ভাল হবে না মন্দ— তার জবাব দেওয়ার দায় প্রধানমন্ত্রীর নেই, পাবলিক সে সব জানতে চায় না, যারা জানতে চায় তারা দেশদ্রোহী।

তবে কি নরেন্দ্র মোদীর পথ কুসুমাস্তীর্ণ? না। তিনি এমন এক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন, যাকে কার্পেট বম্বিং বললে ঠিক বলা হয় না, বরং মনোহর পর্রীকরের প্রিয় পারমাণবিক বোমার সঙ্গেই যার মিল বেশি। এই অস্ত্রের আঘাত চলতে থাকবে এবং ক্রমশ একটা স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে সেই আঘাতের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে। কত মানুষ তাতে জখম হবেন, কতটা জখম হবেন, শেষ পর্যন্ত সেই আঘাত তাঁরা পুণ্যার্থে কৃচ্ছ্রসাধন হিসেবে মেনে নেবেন কি না, নিতান্ত নির্বোধ ছাড়া কেউ তা নিয়ে বাজি ধরবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন