লা স ভেগাস-এ নিহতদের পরিবার-পরিজনকে ‘উষ্ণ সমবেদনা’ জানাইয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প কেবল ইংরাজি ভাষার উপর অত্যাচারের নূতন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন নাই, আরও এক বার জানাইয়া দিয়াছেন, তাঁহার কথাগুলি কথামাত্র, তাহাদের অন্তঃসার খুঁজিয়া লাভ নাই। সোমবারের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বভাবসিদ্ধ ভাষা ও ভঙ্গির পরিবর্তে যে সুগম্ভীর সংযম দেখা গেল, বিচক্ষণ দর্শক তাহাতেও চমৎকৃত হইবেন না। কেবল এই কৃতিত্বটুকু তাঁহাকে না দিলে অন্যায় হইবে যে, তিনি অন্তত এক বার উপদেষ্টাদের পরামর্শ শুনিয়াছেন, নিজের চিত্রনাট্য নিজেই তৈয়ারি করিতে বসেন নাই। তাঁহার মুখে এমন বাণীও শুনা গিয়াছে যে, এই বিপদের দিনে আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ থাকিতে হইবে! দেশের মাটিতে এই ধরনের হিংসার এ যাবৎ চরমতম নজিরটির মুখোমুখি দাঁড়াইয়া দুনিয়ার ‘সর্বাধিক শক্তিমান’ রাষ্ট্রনায়কের আসলে কিছুই বলিবার নাই, ষাট-অতিক্রান্ত একক বন্দুকধারী নির্বিচার গণহত্যার শেষে আত্মঘাতী হইয়া তাঁহাকে এবং তাঁহার প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অসহায় প্রমাণ করিয়াছে।
এই পরিস্থিতির পিছনে মার্কিন সমাজ এবং রাজনীতির বিবর্তনের অবদান বিপুল। এক দিকে সামাজিক বিভেদ, অন্য দিকে অর্থনৈতিক অসাম্য— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক দশক যাবৎ এই দ্বিবিধ ব্যাধিতে গভীর ভাবে আক্রান্ত। নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন ক্রমশ বাড়িয়াছে, রাজনীতি সেই বিভাজনকে দূর না করিয়া তাহাকে আপন মুনাফা তুলিবার মূলধন হিসাবে ব্যবহার করিয়াছে। যে ‘আমেরিকান স্বপ্ন’ এই সমাজের চরিত্রলক্ষণ বলিয়া কীর্তিত হইত, তাহা ক্রমে দুঃস্বপ্নে পরিণত হইয়াছে। নাগরিক হিংসার বিস্ফোরণ তাহার একটি পরিণাম। একের পর এক শহরে, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেও, তাহার ভয়াবহ নমুনা মিলিয়া চলিয়াছে। কী ভাবে এই সংকটের মোকাবিলা করা যায়, রাজনীতিকরা তাহা ভাবিবেন বলিয়া ভরসা হয় না, মার্কিন সমাজকেই বোধ করি পথের সন্ধান করিতে হইবে।
বিদ্বেষ ও হিংসার এই মানসিকতাকে হিংস্র আক্রমণের রূপ দিবার কাজটিতে বিপুল ভূমিকা পালন করিয়াছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখিবার অস্বাভাবিক স্বাধীনতা। স্টিফেন প্যাডক কেন পৈশাচিক তাণ্ডব করিয়াছে, তাহা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু গুচ্ছ গুচ্ছ বন্দুক, এবং উচ্চস্তরের ক্ষমতাসম্পন্ন বন্দুক, দখলে না থাকিলে সে এমন ভয়ংকর ঘাতক হইয়া উঠিতে পারিত না। এহ বাহ্য। গভীরতর সত্য ইহাই যে, বাজারে মুড়িমুড়কির মতো বন্দুক, উচ্চস্তরের ক্ষমতাসম্পন্ন বন্দুক, মিলিলে স্টিফেন প্যাডকরাও মিলিতে থাকিবে। যেমন মার্কিন শহরগুলিতে ক্রমাগত মিলিতেছে। সন্ত্রাস বিশ্বব্যাপী, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার নাগরিক বিপদকে ভিন্ন মাত্রা দিয়াছে। ইহাকে সমাপতন বলিয়া মানিয়া লওয়া কঠিন যে, নেভাদা প্রদেশে আগ্নেয়াস্ত্র কিনিবার, রাখিবার ও ব্যবহার করিবার বিধিনিয়ম অতি শিথিল, কার্যত যে কেহ যত ইচ্ছা বন্দুক, রাইফেল ইত্যাদি রাখিতে পারে। স্টিফেন প্যাডক যেমন রাখিয়াছিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হন। জনমতের একটি বড় অংশ তাঁহার পক্ষে থাকিলেও মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যক্তি-নাগরিকের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর স্বীকৃতিকে কাজে লাগাইয়া সে দেশের বন্দুক ব্যবসায়ীরা এবং তাহাদের সমর্থক রাজনীতিকগণ, বিশেষত রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রতিনিধিরা তাঁহার সমস্ত চেষ্টা বানচাল করিয়াছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান ওবামার বিপরীত মেরুতে, তিনি কার্যত প্রত্যেক নাগরিকের হাতে বন্দুক ধরাইবার পক্ষে সওয়াল করিয়াছেন! লাস ভেগাসের ঘটনা তাঁহার বা তাঁহার ক্ষমতাবান সহমর্মীদের সংবিৎ ফিরাইবে, এমন প্রত্যাশা বাতুলতার নামান্তর।