Editorial News

ছবিটা অসৌজন্যমূলক, গণতন্ত্রের পক্ষে অশুভও

ভারতীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের স্থান অত্যন্ত সম্মানিত। সংবিধান প্রণেতারা ভেবে-চিন্তেই বিরোধী দলের মজবুত উপস্থিতি সুনির্দিষ্ট করে গিয়েছেন ভারতীয় গণতন্ত্রে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৭
Share:

প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে ষষ্ঠ সারিতে রাহুলের আসন। ছবি: সংগৃহীত।

প্রজাতন্ত্রের বা গণতন্ত্রের শোভা বাড়ল না। যে গণতন্ত্রের অসৌজন্যের অভিযোগ উঠে আসছে সরকারের বিরুদ্ধে, তা ওঠা উচিত ছিল না। আসলে এমন অভিযোগ ওঠার অবকাশ তৈরি হওয়াই উচিত না।

Advertisement

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তরে এ মূল্যবোধের প্রদর্শন আরও বেশি করে জরুরি। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসে বিপরীত ছবিই দেখা গেল। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত কুচকাওয়াজে অতিথি-অভ্যাগতদের বসার যে বন্দোবস্ত হল, তা নিয়েই বিতর্ক দানা বাঁধল। দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি কংগ্রেসের সভাপতিকে সামনের সারিতে বসতে দেওয়া হল না। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর বসার বন্দোবস্ত হল ষষ্ঠ সারিতে। স্বাভাবিক ভাবেই গুঞ্জন শুরু হয়েছিল গোড়াতেই। কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার পরে বিতর্ক আরও বেশি ছড়িয়ে গেল। সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ ফলাও করে উঠে এল।

প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে কেন রাহুল গাঁধীর বসার ব্যবস্থা প্রথম সারিতে হল না, কেন ষষ্ঠ সারিতে বসতে হল কংগ্রেস সভাপতিকে, তা নিয়ে সরকার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে। দশটি আসিয়ান দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হাজির ছিলেন অতিথি হিসেবে এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবসে, যা ইতিহাসে বেনজির। স্বাভাবিক ভাবেই কূটনৈতিক তথা আন্তর্জাতিক অতিথি-অভ্যাগতদের তালিকা এ বার যতটা লম্বা ছিল, তা ইতিহাসে বেনজির। সেই কারণেই সামনের সারিতে ঠাঁই হয়নি কংগ্রেস সভাপতির, যা ইতিহাসে বেনজির। সরকারের তরফ থেকে এমনই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে ব্যাখ্যায় চিঁড়ে ভিজছে না। কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল মনে করছে, সরকার চাইলেই রাহুলের বসার বন্দোবস্ত প্রথম সারিতে হতে পারত। আন্তর্জাতিক অতিথিদের তালিকা যতই লম্বা হোক, প্রধান বিরোধী শক্তির শীর্ষ পদাধিকারীর বসার বন্দোবস্তটা প্রথম সারিতে হবে না, এমনটা মেনে নেওয়া শক্ত।

Advertisement

আরও পড়ুন
রাহুলের আসন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

সরকার সম্ভবত বুঝতে পেরেছে, রাহুলের আসন ষষ্ঠ সারিতে ঠেলে দেওয়া খুব দৃষ্টিনন্দন বিষয় হয়নি। তাই প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত ‘অ্যাট হোম’ অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সভাপতির বসার ব্যবস্থা হল ভিভিআইপিদের মাঝেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই এগিয়ে গেলেন কংগ্রেস সভাপতির দিকে, করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে। সহাস্য সৌহার্দ্য বিনিময়ও হল। কিন্তু এই ছবি তৈরি হওয়ার আগেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে যে ধাক্কা লাগার, তা লেগে গিয়েছে।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

ভারতীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের স্থান অত্যন্ত সম্মানিত। সংবিধান প্রণেতারা ভেবে-চিন্তেই বিরোধী দলের মজবুত উপস্থিতি সুনির্দিষ্ট করে গিয়েছেন ভারতীয় গণতন্ত্রে। ব্রিটিশ সংবিধানের উত্তরাধিকার হিসেবেই হোক বা ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের মূল্যবোধের উত্তরাধিকার, বিরোধী দল বা বিরোধী নেতা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গণতন্ত্রকে মজবুত করার লক্ষ্যেই যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিরোধী দলের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সংবিধানে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক তাই ভারতের গণতান্ত্রিক প্রথা বিরোধী শক্তিকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়ার ছবি তৈরি করে আসছে। এ বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে সে ছবির ব্যতিক্রম ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সম্ভবত বুঝেছেন, কুচকাওয়াজের সময় দর্শকাসনের ষষ্ঠ সারিতে কংগ্রেস সভাপতিকে বসে থাকতে দেখা যাওয়া মোটেই দৃষ্টিনন্দন হয়নি। সেই জন্যই সম্ভবত রাষ্ট্রপতি ভবনে সৌজন্যের এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এক দৃষ্টিসুখকর ছবি তৈরি করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।

কংগ্রেস বলছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। বিজেপি তথা সরকার পক্ষ বলছে, প্রতিহিংসার প্রশ্নই নেই, অপারগতা। কিন্তু অপারগতার তত্ত্বে বিশ্বাস রাখা বেশ কঠিন। বিদেশি অতিথির সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিরোধী দলের প্রধানের জন্য একটা আসন সামনের সারিতে রাখা গেল না, এ তত্ত্ব মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। প্রথম সারিতে শুধু নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম সারিতেও রাহুল গাঁধীকে বসার জায়গা দেওয়া গেল না, এ তত্ত্ব মেনে নেওয়াও যথেষ্ট কঠিন। ইচ্ছাকৃত অসৌজন্য প্রদর্শন বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ সেই কারণেই গুরুত্ব পাচ্ছে।

রাহুল গাঁধীর বসার ব্যবস্থা নিয়ে যা ঘটল, তা যে কারণেই ঘটে থাকুক, এমন অসৌজন্যমূলক ছবি আর যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়ে যত্নবান হওয়া উচিত সরকারের। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত উপলব্ধি করেছেন বিচ্যুতিটা। সেই কারণেই সম্ভবত সংশোধনের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু বার বার বিচ্যুতি এবং তার পরে বার বার সংশোধন কোনও কাজের কথা নয়। এ কথা সরকার পক্ষকে মনে রাখতে হবে। হতে পারে, কংগ্রেস সভাপতির আসন বিভ্রাট নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হতে পারে, এই ঘটনা ইচ্ছাকৃত ঘটানো হয়নি। হতে পারে, ভবিষ্যতে আরও অনেক গণতান্ত্রিক আয়োজনে এই রকম ত্রুটি আর দেখা যাবে না। কিন্তু ত্রুটি যে ঘটেছে তা স্বীকার করে নেওয়া জরুরি। সরকারের তরফ থেকে এই বিচ্যুতির দায় নেওয়াও জরুরি। ভবিষ্যতে এমন বিচ্যুতির মুখোমুখি আর হবে না আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, এ কথা স্পষ্ট করে বলাটা জরুরি। তাতে গণতন্ত্র মজবুত তো হবেই, শাসক দলের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন