দুই পৃথিবী

প্রাক্তন এক পঞ্চায়েত প্রধানই নাকি শাস্তির দৃশ্যটি মোবাইলবন্দি করিবার পরামর্শ দেন, যাহাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ‘প্রণয়াপরাধী’রা ইহা দেখিয়া ভয়ে সেই ঘৃণ্য কর্ম হইতে বিরত থাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০০:২১
Share:

উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামে এক ‘ব্যভিচারিণী’কে শাস্তি দেওয়া হইল, প্রকাশ্যে তাঁহাকে প্রহার করিয়া। প্রহার করিল তাঁহার স্বামী, আর দাঁড়াইয়া দেখিল বহু মানুষ। কেহ প্রতিবাদ তো করিল না-ই, বরং কেহ কেহ হাসিল, মজা চাপিয়া রাখিতে পারিল না। আর এই সমস্ত এক প্রকার ‘আইনসম্মত’ ভাবেই হইল, কারণ গ্রাম পঞ্চায়েতই রায় দিয়াছিল, এই মহিলা যেহেতু স্বামীকে ছাড়িয়া তাঁহার প্রেমিকের সহিত পলায়ন করিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার উপযুক্ত শাস্তি। প্রাক্তন এক পঞ্চায়েত প্রধানই নাকি শাস্তির দৃশ্যটি মোবাইলবন্দি করিবার পরামর্শ দেন, যাহাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ‘প্রণয়াপরাধী’রা ইহা দেখিয়া ভয়ে সেই ঘৃণ্য কর্ম হইতে বিরত থাকে। ভিডিয়োটিতে দেখা যাইতেছে, মহিলার হাত দুইটি গাছে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে, আর স্বামী তাঁহাকে নির্মম ভাবে পিটাইতেছে ও হিন্দিতে বলিতেছে, ‘এই বার দেখি কেমন পলাইয়া যাইতে পারিস!’ এক সময়ে মহিলার আর্তনাদ থামিয়া যায়, তিনি সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়েন। ভিডিয়োটি ‘ভাইরাল’ হইবার পর পুলিশ নড়িয়া বসিয়াছে, মহিলার সহিত কথা বলিয়া স্বামী এবং আরও কয়েক জনকে গ্রেফতার করিয়াছে। মহিলা নাকি এমনও অভিযোগ করিয়াছেন, প্রহারকাণ্ডের পর প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান ও তাহার কয়েক জন সঙ্গী তাঁহাকে একটি ঘরে লইয়া যাইয়া যৌন নিগ্রহ করে এবং হুমকি দিয়া বলে, এই বিষয়ে নীরব থাকিতে। এমন ঘটনা ভারতে নূতন নহে। গ্রামে বিচারসভা বসিল এবং একটি মানুষকে প্রকাশ্যে প্রবল নিগ্রহ করা হইল, ইহা প্রচলিত অভ্যাস। মোবাইল বস্তুটি তো হালে আসিয়াছে, তাহার পূর্বে এমন কত শত ঘটনা যে ঘটিয়াছে ও অধিকাংশের অগোচরে রহিয়া গিয়াছে, কত বধূ চূড়ান্ত নিগৃহীতা হইয়া বৎসরের পর বৎসর কাঁদিয়াছেন, এক সময়ে হয়তো বিশ্বাসও করিয়াছেন যে তিনি এই ব্যবহারেরই উপযুক্ত, তাহা কে জানে।

Advertisement

নারীর চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, এই বিষয়ে বহু ভারতীয়ের মনোভঙ্গি ও মূল্যবোধ অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সম্ভবত অনড়। যে সিরিয়ালগুলি টিভি ছাইয়া ফেলিয়াছে, তাহা লক্ষ করিলেই বুঝা যায়, প্রায় প্রতিটিই এমন নায়িকাকে কেন্দ্রে রাখিয়াছে, যে ভীরু, নমনীয়, অনুগত, অন্যায় সহনকারিণী। সে প্রথাগত শিক্ষা পায় নাই এবং শহুরে সহবতে অনভ্যস্ত। সে (স্বামীর) পরিবারের সকলের ভাল চাহিয়া, নিজের ইচ্ছাকে সামান্যতম অগ্রাধিকার না দিয়া, কেবল অন্যের নিমিত্ত নিজেকে নিবেদন করে। অর্থ উপার্জন করিলে তাহা ব্যয় করে স্বামীর ব্যবসা ও ননদের চিকিৎসার জন্য, রাঁধিয়া শ্বশুরের নিকট তারিফ শুনিলে তাহাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মনে করে। সে প্রতিনিয়ত চূড়ান্ত অপমানের সম্মুখীন হইয়াও, পরিবার ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার পরিবর্তে পরিবারকে ভিতর হইতে শুদ্ধ করিবার চেষ্টা করে। কোনও সূক্ষ্ম বার্তার প্রশ্ন এখানে নাই, বারংবার এই কথা স্পষ্ট করিয়া বলা হয়, অন্যের কল্যাণের যূপকাষ্ঠে আত্মবিসর্জনই ভারতীয় নারীর প্রধান কর্তব্য। এই আত্মত্যাগী নারীটিকে অশেষ নিগ্রহের মধ্য দিয়া যাইতে হয়। তাহার অত্যাচারের মূল কান্ডারি কয়েক জন শহুরে নারী, যাহারা বিত্তলোভী, সাজসজ্জার প্রতি মনোযোগী। সান্ধ্য পার্টিতে যাইয়া চটুল সংগীতের তালে নৃত্য করিতে ভালবাসে। সর্বোপরি, তাহারা মদ্যপান করে। এক দিন অবশ্য প্রগাঢ় সঙ্কটে তাহারা সেই নারীটিকেই পার্শ্বে পায়, যাহার চক্ষে তাহারা অ্যাসিড ঢালিয়া দিয়াছিল, বা যাহার শিশুকে বিক্রয় করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু নায়িকাটি সকল চ্যুতি ক্ষমা করিয়া সকলকে বক্ষে টানিয়া লয়। ইহার পর কোনও সিরিয়ালে যদি কোনও নারী বৃক্ষে রজ্জুবদ্ধ হইয়া প্রহৃত হইবার পর, এক দিন স্বামীকে পরম ক্ষমায় ও প্রেমে সিক্ত করিয়া গ্রহণ করিয়া লয়, বিস্ময়ের কিছু নাই। আশ্চর্য, আজ হইতে ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পূর্বের ভারতীয় চলচ্চিত্রেও অবিকল এই পুংতান্ত্রিক বার্তাই এই ভঙ্গিতেই প্রদান করা হইয়াছে। অর্থাৎ, শহরে বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, যতই #মিটু আছড়াইয়া পড়ুক না কেন, এই দেশ রহিয়াছে বহু পুরাতন একটি দেশেই, যাহা পুংতন্ত্রের বশ হইয়া বিশ্বাস করে, প্রাচ্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী নারী হইবে আত্মমর্যাদাহীন, আত্মসুখরোধী। যে নারী শিক্ষা ও পরিশীলন আয়ত্ত করিয়া, নিজ আনন্দকে মূল্য দিতে অভ্যস্ত, সে পাশ্চাত্যের কুপ্রভাবে বিপথগামিনী। তাহাকে প্রকাশ্যে ও বিপুল সমর্থনে চাবকাইয়া সংজ্ঞাহীন করিয়া দেওয়া সমাজের এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে। এই ‘শহর’ ও ‘গ্রাম’-এর দুই পৃথক পৃথিবীর সীমারেখা মুছিয়া দিবার অতিমানবিক প্রয়াস না লইলে, এই দেশে নারীবাদের প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কম।

যৎকিঞ্চিৎ

Advertisement

ঠাকুরপুকুরের একটি বাড়ি থেকে চোরেরা চুরি করল তিনটি খাট, একটি ড্রেসিং টেবিল, দুটো গ্যাস সিলিন্ডার, গ্যাস আভ্ন, বহু শাড়ি পাজামা টি-শার্ট অন্তর্বাস, টাকা গয়না তো বটেই। সঙ্গে নিয়ে গেল দুটো দরজাও! এই হচ্ছে সত্যিকারের সিরিয়াস চুরি, যেখানে কোনও বস্তুই ফেলে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। মা বলতেন, চাঁছিপুঁছি করে খেয়ে নাও, কিচ্ছু যেন পড়ে না থাকে। বাবা বলতেন, সিলেবাস একদম কমপ্লিট করো। চোরেরা নিজ শাস্ত্রের প্রতি খাঁটি শ্রদ্ধাশীল। পরীক্ষার্থীদের শেখা উচিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন