কারা যেন বলেছিলেন কথাটা। হয়তো বিজ্ঞানীরা। ওঁরা ছাড়া আর কে-ই বা সত্যদ্রষ্টা হন? মন্তব্যটা উঠে এসেছিল সেই ১৯৭০-এর দশকে। যখন প্রথম বড় আকারে শোনা গিয়েছিল পরিবেশ দূষণের কথা। মানুষ সচেতন হচ্ছিল সমস্যাটা নিয়ে। অশনিসংকেতের মধ্যেও একটা বার্তা মিলেছিল ঠিক। বার্তাটি ছিল আন্তর্জাতিকতার। ঠান্ডা লড়াই কিংবা দ্বিমেরু বিশ্বের মানুষ টের পেয়েছিল যুদ্ধবিগ্রহ, দারিদ্র, অনাহার, রোগজ্বালার চেয়েও মারাত্মক এক বিপদ ওত পেতে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সে বিপদ মানে না রাষ্ট্রের সীমানা। সে উদোর পিণ্ডি ফেলতে পারে বুধোর ঘাড়ে। একের পাপের বোঝা চাপতেই পারে অন্যের মাথায়। পরিবেশ দূষণ এমন সমস্যা, যার কোপে নিস্তার নেই কারও। মন থেকে স্বাদেশিকতা মুছে ফেলতে হবে। নিতে হবে আন্তর্জাতিকতার পাঠ। পরিবেশ দূষণের সেটা বড়় শিক্ষা।
দূষণের প্রতিটি খবর বার বার সে কথা মনে করায়। যেমন করালো সম্প্রতি। জানা গেল, সুমেরু অঞ্চলের সমুদ্র, যা মানুষের চোখে বহু কাল বিশুদ্ধতম জলাধার, তার জঠরে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড়। গ্রিনল্যান্ডের চার পাশে আর বারেন্টস সাগরে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের ঢেউয়ে এসে জমা হচ্ছে। জমার পরিমাণ উদ্বেগজনক। হিসেব বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা মাছের ওজনের চেয়েও বেশি হবে।
স্পেল-এ কাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী আন্দিস কোজার বহু দিন ধরে সমীক্ষা চালাচ্ছেন সমুদ্র দূষণ নিয়ে। সম্প্রতি নানা দেশের ১১ জন গবেষক সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘুরেছেন সুমেরু এলাকার সাগরে। ওখানে জল অনেক জায়গায় বরফ অবস্থায়। তবু যেখানে যেখানে তা তরল অবস্থায়, চলতে পারে তার মধ্য দিয়ে ট্রলার, সেখানে সেখানেই দলবল নিয়ে ঘুরেছেন কোজার। মেপেছেন ভাসমান কিংবা গভীরে নিমজ্জিত প্লাস্টিক। তৈরি করেছেন আট পাতার রিপোর্ট। যা সদ্য প্রকাশিত ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে। রিপোর্টে কোজার এবং তাঁর সহযোগী গবেষকরা জানাচ্ছেন, গ্রিনল্যান্ড এবং বারেন্টস সাগরে ভাসমান প্লাস্টিকের ওজন হবে প্রায় ১২০০ টন। এর মধ্যে ৪০০ টন হল নানা রকম আস্ত জিনিস। যাদের সংখ্যা ৩০ হাজার কোটি।
প্লাস্টিকের কী কী দ্রব্য সাগরে পান গবেষকেরা? বোতল, খেলনা, মাছ ধরার জাল, দড়ি, জুতো এমনকী টুথব্রাশ। গত বছর এ ব্যাপারে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘নেচার’ পত্রিকা জানিয়েছিল, হাওয়াই দ্বীপ এলাকায় সমুদ্রে জলের উপরিভাগের ওজনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই প্লাস্টিক। আর পৃথিবীর নানা সমুদ্রের হিসেব একসঙ্গে জুড়লে জলে জমা জঞ্জালের ৫০-৮০ শতাংশ ওই বস্তু। তিন বছর আগে এক দল মার্কিন গবেষক হাওয়াইয়ের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে জলের তলায় পেয়েছিলেন পেল্লায় এক জাল। যার ওজন সাড়ে এগারো টন। প্রায় একটা বাসের ওজন।
গত বছর মে মাসে রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ প্রকল্পের যে অধিবেশন বসেছিল নাইরোবি শহরে, সেখানেও জানানো হয়েছিল এই তথ্য যে, সমুদ্রে পরিত্যক্ত মাছ ধরার সরঞ্জাম প্লাস্টিক দূষণের এক মোটা অংশ। এর মোট পরিমাণ আনুমানিক ৬,৪০,০০০ টন। অধিবেশনে এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে, সমুদ্রে জমা প্লাস্টিক ক্রমশ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কত বড় সে সমস্যা, তা এত দিন বোঝা যায়নি। কারণ, বিজ্ঞানীরা সরেজমিন তদন্তে তেমন করে নামেননি। এখন নামছেন, তাই জানা যাচ্ছে অনেক তথ্য। বিজ্ঞানীদের তরফে বাড়তি উদ্বেগের ফলে তৈরি হয়েছে এক ডেটাবেস বা তথ্যভাণ্ডার। LITTERBASE। ক্লিক করলে যেখানে গবেষকদের ছাপানো ১,৩০০ পেপার। শুধু প্লাস্টিক জঞ্জাল নয়, সমুদ্রে মানুষের ফেলা সব রকম আবর্জনার তথ্য। প্লাস্টিক দূষণ যে সে-সবের অনেকখানি জুড়ে, তা বলাই বাহুল্য।
সমস্যা সত্যিই বড় আকার ধারণ করছে। চাহিদা বাড়ছে। পৃথিবীতে এখন প্লাস্টিকের উৎপাদন বছরে ৩০ কোটি টন। এর অনেকটার শেষমেশ ঠিকানা সমুদ্র। বিশেষজ্ঞরা এখন সাইজ বিচারে সমুদ্রে প্লাস্টিকের জঞ্জালের ওজন মাপছেন। মাইক্রোপ্লাস্টিক (০.৩৩-১ মিলিমিটার) সংখ্যায় ১,৮৩,০০০ কোটি, মোট ওজন ৭,০৪০ টন। বড় মাইক্রোপ্লাস্টিক (১.০১-৪.৭৫ মিলিমিটার) সংখ্যায় ৩,০২,০০০ কোটি, মোট ওজন ৭,০৪০ টন। বড় মাইক্রোপ্লাস্টিক (সাইন ২০০ মিলিমিটারের বেশি) সংখ্যায় ৯,০০০ কোটি, ওজন ২,০২,৮০০ টন।
গবেষকরা সামুদ্রিক প্রাণীর রক্ত এমনকী মাংসপেশিতেও প্লাস্টিক কণার সন্ধান পাচ্ছেন। এ সব আবিষ্কার বাড়াচ্ছে চিন্তা। সমুদ্রের মাছ তো মানুষের খাদ্য। তা হলে কি আমাদের আবর্জনা গিলছি আমরাই?
দূষণ, তোমার খুরে দণ্ডবৎ! প্রথমে শিখিয়েছিলে স্বাদেশিকতা বিসর্জন দিতে। এখন দেখাচ্ছ স্বখাত সলিলে ডুবে মরার ভয়!