State news

হরিপদরাই সবচেয়ে বিপদে

রাজকুমার রায় নামে যে স্কুল শিক্ষক তথা প্রিসাইডিং অফিসারের রহস্যজনক মৃত্যু হল, তাঁর পরিবার-পরিজনদের মনে প্রশ্ন জাগল, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এই রকম মূল্য দিতে হয়?

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৮ ০০:৪১
Share:

প্রতীকী ছবি।

ভয়াবহ হিংসার ছবি দেখা গেল পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে। সে নির্বাচন দেখার পরে নানান উপলব্ধি সামনে এল।

Advertisement

রাজকুমার রায় নামে যে স্কুল শিক্ষক তথা প্রিসাইডিং অফিসারের রহস্যজনক মৃত্যু হল, তাঁর পরিবার-পরিজনদের মনে প্রশ্ন জাগল, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এই রকম মূল্য দিতে হয়? যে ভোটকর্মীদের তুমুল বিক্ষোভে রায়গঞ্জ উত্তাল হল, তাঁদের মনে হল, প্রশাসনের উচ্চস্তর আসলে সাধারণের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিতই নয়। গুলি বা বোমায় লুটিয়ে পড়লেন যে রাজনৈতিক কর্মী, তাঁর পরিজনদের মনে হল, গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এ রাজ্যে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মনে প্রশ্ন জাগল, কেন এত সংখ্যক তৃণমূল কর্মীকেই প্রাণ দিতে হবে ভোটে? নরেন্দ্র মোদীর মনে হল, বাংলায় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। তা শুনে আবার নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেনের মন প্রশ্ন জাগল, গণতন্ত্রের কথা নরেন্দ্র মোদীর মুখ থেকে শুনতে হবে?

এত প্রশ্ন আর এত রকম দৃষ্টিভঙ্গির গোলোকধাঁধায় সসেমিরা অবস্থা হরিপদ কেরানির। হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা তাঁর। তিনি বুঝতেই পারছেন না, কার দৃষ্টিভঙ্গিটা সঠিক, কার তোলা প্রশ্নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কার মতামতে আস্থাশীল হওয়া যায়।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

হরিপদ কেরানি হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁকে প্রথম যৌবনে এক রাজনৈতিক দর্শন নাড়া দিয়েছিল এবং স্বপ্ন দেখিয়েছিল যে, কেরানিকেও আকবর বাদশাহের সমকক্ষ হিসেবে দেখা হবে একদিন। তার পরে কয়েক দশক কেটেছে, স্বপ্নভঙ্গের ছবিটা ক্রমে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রিসাইডিং অফিসারের রহস্যমৃত্যু, উত্তাল রায়গঞ্জ, এসডিও-কে জুতো, চড় ভোটকর্মীদের

প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হরিপদ কেরানি এর পর পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলেন। সে পরিবর্তন আকবর বাদশাহের পাশে হয়তো বসাবে না, কিন্তু সুদীর্ঘ অন্যায়ের অবসান ঘটাবে, গণতন্ত্রের উঠোনে যে শ্বাসরোধী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার অবসান ঘটিয়ে খোলা হাওয়া এনে দেবে— এমনই মনে হয়েছিল কেরানির।

কিন্তু কেরানি এর পরে দেখলেন, পরিবর্তন তাঁকে অচিরেই পৌঁছে দিয়েছে এক কোণঠাসা গুহা-গহ্বরে। সে গহ্বরে নির্দয় শাসকের তীব্র হুঙ্কার, সে গহ্বরে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বরের নিধনযজ্ঞ, সে গহ্বরের নিকষ অন্ধকারে গণতন্ত্র হাঁসফাঁস।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে পঞ্চায়েত নির্বাচন চলে এল বাংলায়। রক্ত, রক্ত আর মৃত্যুতে আকুল হয়ে পড়তে হল গোটা রাজ্যকে। এক এক জন এক এক রকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মেতে উঠলেন। কিন্তু এই তুমুল ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিশাহারা হয়ে পড়া সাধারণ মানুষের প্রতিভূ যে হরিপদ কেরানি, তাঁর দরজায় পৌঁছতে পারলেন না কেউ। হা-ক্লান্ত দিন, অবসন্ন রাত, দীর্ণ রোজনামচার প্রান্তে হরিপদ কেরানির যে ঘর, সেই ঘর থেকে কেমন দেখাচ্ছে আজকের এই রক্তাপ্লুত ভূমিকে, তা কেউ দেখতে পেলেন না।

ভোটের বলি যাঁরা, তাঁদের ঘর আজ সর্বস্বান্ত। তাঁদের ঘর থেকে অন্য কারও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাইরে তাকানো সম্ভব নয় এই মুহূর্তে। কিন্তু সমাজে, রাজনীতিতে বা রাষ্ট্রনীতিতে যাঁরা মার্গদর্শক, তাঁদের নজরে এবং উপলব্ধিতে সামগ্রিকতা থাকা জরুরি। নিজের নিজের অবস্থান থেকে দেখার বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ করার সময়টা কিন্তু আর নেই। ঘোর দুঃসময় সমাগত। এ বার সবাইকে সবার সঙ্কট বুঝতে হবে। খণ্ডিত নয়, সার্বিক উপলব্ধিতে পৌঁছতে হবে। কারণ সঙ্কটের শিকড়টা ধরে সবাই মিলে টান মারা দরকার। আর সেই শিকড়টাকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় ওই সার্বিক উপলব্ধির ভূমিটাতে দাঁড়িয়েই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন