—ফাইল চিত্র।
সন্ন্যাসী হওয়া বড় সহজ কথা নহে। সেই ত্যাগের দাবি সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী। পরিবারপরিজন, বিত্ত, প্রতিপত্তি তো ছাড়িতে হয়ই, ছাড়িয়া আসিতে হয় আপন অতীতের সত্তাটিকেও। সেই সত্তার অস্তিত্ব মুছিয়া, নিজের অতীতকে মৃত ঘোষণা করিয়া তবে প্রকৃত সন্ন্যাসে প্রবেশ সম্ভব। তাহার পরে সন্ন্যাসীর নিকট পূর্বাশ্রমের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। কোনও অর্থ থাকে না জাগতিক কিছুরই। রামমন্দির নির্মাণকল্পে সংগৃহীত টাকা লইয়া বিবদমান গেরুয়াধারীরাও সম্ভবত কথাগুলি জানেন। সম্ভবত তাঁহারা জ্ঞানপাপী। তাঁহারা গেরুয়া ধরিয়াছেন, কিন্তু জগৎ ছাড়েন নাই। কোন গোষ্ঠীর হাতে টাকা থাকিবে, মন্দির নির্মাণের অধিকার কাহার হইবে, তাহা লইয়া আখড়ায় আখড়ায় বিবাদ লাগিয়াছে। সুপ্রিম কোর্টেও মামলা লড়িবে, জানাইয়াছে এক আখড়া। অন্যরাও হয়তো পিছাইয়া থাকিবে না। এই জাগতিক অধিকার লইয়া সন্ন্যাসীরা এত উতলা কেন? উত্তরটি অনুমান করা চলে: তাঁহারাও জানেন, ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে প্রাসঙ্গিক থাকিতে হইলে রামমন্দির নির্মাণের দাবিটিকে হাতছাড়া করিলে চলিবে না।
অতঃপর প্রশ্ন, রাজনীতির পরিসরেই বা সন্ন্যাসীদের আগ্রহ থাকিবে কেন? তাহার উত্তর ধর্মে নাই, সন্ন্যাসে নাই, আছে রাজনীতিতে। রাজনীতি ও ধর্মের সঙ্গম যে মহাপ্রয়াগে, সেখানেই অবস্থান রামমন্দির নামক ধারণাটির। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভোটের স্বার্থে ক্রমাগত সেই ধারণাটিকে ব্যবহার করিয়া চলিয়াছে। ভারতীয় গণতন্ত্র সাক্ষী, সেই ব্যবহার ব্যর্থ হয় নাই। আপাত-ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি বিজেপিকে সংসদে মাত্র দুইটি আসনে নামাইয়া আনিয়াছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণীর মন্দিরপন্থী হিন্দুত্ব তাঁহাদের ফের জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। মন্দিরের হুঙ্কারে তাঁহারা রাজ্যজয় করিয়াছেন। ২০১৪ সালে, ‘বিকাশপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদীর আবির্ভাবের মাহেন্দ্রক্ষণেও বিজেপির ইস্তাহারে ‘রামমন্দির’ ছিল। ভারতীয় রাজনীতি জানে, ভোট আসিলে মন্দিরও আসিবে। আর, সেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আয়ুধ হিসাবেই আসিবেন গেরুয়াধারীরা। অনিচ্ছায় নহে, স্বেচ্ছায়। তাঁহারা জানিয়াছেন, শুধু এই পরিচিতিটুকুর কারণেই রাজনীতিতে, জাতীয় জীবনে, ক্ষমতার অলিন্দে তাঁহাদের গুরুত্ব আছে। কেহ বলিতেই পারেন, মন্দির নির্মাণে নরেন্দ্র মোদীর আগ্রহ নাই— তিনি শুধু প্রসঙ্গটিকে নির্বাচনী প্রচারে রাখিতে চাহেন, নচেৎ অ-বিতর্কিত জমি ছাড়িয়া দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আদালতে জানাইতে পদ্ধতিগত গাফিলতি করিত না সরকার। গেরুয়াধারীরাও সম্ভবত এই কথাটি জানেন। কিন্তু আরও জানেন, প্রাসঙ্গিক থাকিতে হইলে মন্দিরের দাবিতে নিজেদের নাম টিকাইয়া রাখিতে হইবে। সন্ন্যাস? সে প্রশ্ন থাক।
একটি ভিন্নতর প্রশ্ন আরও অনেক বেশি বাস্তবোচিত। গত শতকের শেষ দশকে মন্দিরের দাবি যে ভাবে ব্যালট বাক্স ভরাইয়া দিত, ২০১৯-এর ভোটাররাও কি সেই আবেগেই তাড়িত হইবেন? এই প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর শুধু ইভিএমগুলি জানিবে, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম হইতে আশাবাদী হওয়ার সূত্র মিলিতে পারে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাম্প্রতিক ধর্মসভাগুলিতে উপস্থিত জনতার প্রতিক্রিয়া, মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে আলোচনা, বিজেপির রাজনীতি হইতে লালকৃষ্ণ আডবাণী, উমা ভারতী বা মুরলীমনোহর যোশীদের ন্যায় মন্দির-রাজনীতির মুখ নেতাদের প্রস্থান— সবই সঙ্কেত দিতেছে: মন্দিরের আর সেই টান নাই। মন্দির তৈরি হইলে হিন্দু ভারত হয়তো আপত্তি করিবে না, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের নিকট অধিকতর জরুরি কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। নির্বাচনী প্রশ্ন হিসাবেও সর্বজনীন আয়, কৃষি বা কর্মসংস্থানের কথা উঠিয়া আসিতেছে। মন্দির সাধারণ মানুষের পেট ভরাইবে না। যাঁহারা ততখানি ‘সাধারণ’ নহেন, তাঁহারা বিবদমান।