নেহরুপুজো থেকে পটেলপুজো, ঐকমত্যহীন বিকাশ ও অগণতান্ত্রিক অনুদারবাদের রাজনীতি

২০১৫ সালে ১৪ নভেম্বর  সকালে মোদীর টুইট: পণ্ডিত জওহরলালের জীবন অনেকটাই কেটেছে ভারতের স্বাধীনতা আনতে, আর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারতকে নেতৃত্ব দিতে। ২০১৫ সালে এই দিনটিতে মোদী লন্ডনে ছিলেন। তবে ২০১৪-র মতো ২০১৫ সালে তেমন হইচই বাধাননি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

২০১৪। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেহরুর জন্মদিনটিতে নরেন্দ্র মোদী ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান তিনি। নেহরুর জন্মদিনকে শিশুদিবস হিসাবে মানা হয়। সে দিন ভারতের ইতিহাসে নেহরুর অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। ২০১৫ সালে ১৪ নভেম্বর সকালে মোদীর টুইট: পণ্ডিত জওহরলালের জীবন অনেকটাই কেটেছে ভারতের স্বাধীনতা আনতে, আর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারতকে নেতৃত্ব দিতে। ২০১৫ সালে এই দিনটিতে মোদী লন্ডনে ছিলেন। তবে ২০১৪-র মতো ২০১৫ সালে তেমন হইচই বাধাননি।

Advertisement

২০১৬ সালে এই দিনটিতে তিনি স্বদেশেই ছিলেন। সে দিন গাজিপুরে গিয়ে তিনি নেহরুর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক জনসভায় মোদী বলেন ‘‘পণ্ডিত নেহরুজি! আপনার পরিবারের সদস্যরা আজ আমাকে গালিগালাজ করছেন, কিন্তু আমি আপনার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে এসেছি। ১৪ নভেম্বরে আমি এখানে এসেছি তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য। ওরা আপনার স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করেননি। আমি করছি।’’ গাজিপুর বারাণসীর গায়ে-লাগা এক ছোট শহর। মোদী বলেন, ‘‘এই পূর্বাঞ্চলের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। নেহরু তা বুঝে একটি কমিটি গঠন করেন। এই এলাকার জন্য সেই কমিটি কী কী সুপারিশ করেছিল তার রিপোর্ট পরবর্তী কালে কোনও প্রধানমন্ত্রীই খুলে দেখেননি। আমি সেই ফাইল খুলে এই এলাকার উন্নয়ন করছি। সেটাই আমার নেহরুজির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।’’

অর্থাৎ ২০১৬ সালেও মোদী নেহরু হতে চাইছেন। সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, নেহরু সম্পর্কে সঙ্ঘ পরিবারের সমালোচনা তীব্র হলেও মোদী নেহরুর প্রশংসা করে এক পরিণত রাজনীতির নমুনা রাখলেন। ২০১৭ সালে নেহরুর জন্মদিনে মোদী ম্যানিলায় ছিলেন। সে দিন কিন্তু সকালবেলা তাঁর টুইট সংক্ষিপ্ত: ‘‘ট্রিবিউটস টু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু অন হিজ় বার্থডে।’’ ব্যস, এইটুকুই।

Advertisement

আরও পড়ুন: গণনাট্য সঙ্ঘ রাজনৈতিক মতাদর্শের মুখপাত্র ছিল না

২০১৮ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদের দু’টি কক্ষেই মোদী বললেন, ‘‘ভারত সব চেয়ে বড় যে সমস্যা ভোগ করেছে, তার নাম নেহরু।’’ সে দিনের বক্তৃতা শুনে বুঝলাম, এ বার মোদী ফিরে এসেছেন সঙ্ঘের পুরনো অবস্থানেই। সে দিন সংসদে আবার আমরা ২০১৩ সালের গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকেই দেখতে পেলাম। শুধু নেহরুর তীব্র সমালোচনা নয়, বল্লভভাই পটেলের অবদানের কথাও তুলে ধরলেন মোদী। পটেল ছিলেন বলে দেশটা ঐক্যবদ্ধ ছিল। নেহরুর জন্য নয়।

উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাই গাঁধীর হত্যাকারী, তবুও মোদী বললেন, এ দেশ জানে না আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ গাঁধীকে কতটা দিয়েছে। আর সর্দার পটেল এই জাতীয়তাবাদীদের সম্পর্কে উদার মনোভাব পোষণ করতেন। ৩১ অক্টোবর সর্দারের ১৪৩তম জন্মদিনে তাঁর মূর্তিটি দেশকে উৎসর্গ করার পর মোদী সচেতন ভাবেই নেহরু-গাঁধীকে ছোট করে পটেলকে তুলে ধরে এক রাজনৈতিক আখ্যান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মূর্তির নাম ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’! কিন্তু সামাজিক ঐক্য কই?

আরও পড়ুন: এ ধার থেকে ও ধার পর্যন্ত চোদ্দটা মৃতদেহ!

অক্টোবর নভেম্বর দু’মাসে ভারতের তিন নেতার জন্ম! ২ অক্টোবর গাঁধী দিয়ে শুরু, ৩১ অক্টোবর পটেল, ১৪ নভেম্বর নেহরু। বিতর্ক এই তিন জনকে নিয়েই। মোদী বলছেন পটেল ছিলেন বলে ভারতে রাজ্যওয়ারি ঐক্য তৈরি হয়েছিল। দেশভাগের জন্য নেহরু দায়ী, পটেল নন। কাশ্মীরের যেটুকু আমরা পেয়েছি, তা নাকি শুধু পটেলের জন্যই।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার কিছু বিনীত প্রশ্ন আছে। প্রথমত, ৩১ অক্টোবর পটেলের মূর্তি যদি জাতীয় ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে, তবে সে দিনের অনুষ্ঠানে কেন আপনি কংগ্রেস ও বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানালেন না? আমার তো মনে হচ্ছে আপনি এই অনুষ্ঠানে সবাইকে না ডেকে আসলে ‘স্টেটসম্যান’ তথা জাতীয় নেতা সাজার একটা সুযোগ হারালেন!

দ্বিতীয় প্রশ্ন, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের আপনি আমন্ত্রণ জানালেন না কেন? প্রয়োজনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে নানা দলের মুখ্যমন্ত্রীদের তাতে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারতেন। এমনকি সংসদেও বিষয়টি নিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। কথাবার্তা না হওয়ায় কি এটি কার্যত গুজরাতের আঞ্চলিক ঘটনায় পরিণত হল না?

তৃতীয় প্রশ্ন, পটেলকে আপনি আত্মসাৎ করতে চাইছেন, কিন্তু তিনি তো আদতে এক জন কংগ্রেস নেতাই ছিলেন, যে নেতা আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করেন, গাঁধীজির হত্যার পর আরএসএস সম্পর্কে যাঁর মনোভাবে আসে বিরাট পরিবর্তন।

চতুর্থ প্রশ্ন, কংগ্রেসের ইতিহাসে পটেল ছিলেন দক্ষিণপন্থী, সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সমাজতন্ত্রী নেতা। নেহরুকে মনে করা হয় ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবাদী নেতা। এঁদের মধ্যে সে সময়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। সে সব কোনও গোপন কথা নয়। সংবিধান রচনার সময় গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়েছিল, তার দীর্ঘ বিবরণ তো এখন ইন্টারনেটেই দেখা যায়। কিন্তু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মতপার্থক্য যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস অখণ্ড। এখানে পাল্টা একটা খণ্ড-আখ্যানকে অখণ্ড মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেটাই ভারতবর্ষ বললে তা হয় অন্ধের হস্তী দর্শন। ইতিহাস খণ্ড নয়, অখণ্ড সময়প্রবাহ। পাল্টা আখ্যানই যদি গড়তে চান, তবে গুজরাত-অস্মিতা ভুলে আপনি হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের (যাঁদের সঙ্ঘ ভারতরত্ন বলে মনে করে) মূর্তি স্থাপন করলেন না কেন?

আসলে ভারত-দর্শন মূর্তিতে নেই। গাঁধীর চশমা বা চরকার মধ্যেও নেই। সে দর্শন লুকিয়ে আছে তার আত্মায়। নেহরু দেশের আর্থিক বিকাশ করতে চেয়েছিলেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে। যোজনা কমিশনের মাধ্যমে ভারী শিল্প করতে চাইলেও তিনি বিকাশ চাইতেন সকলের জন্য। তাতে এলিটও যেমন ছিল, তেমনই ছিল নিম্নবর্গ। ইন্দিরা গাঁধীর সময়েই এই আলোচনা ও ঐকমত্যের রাজনীতিতে ভাঙন ধরে। জরুরি অবস্থা এর এক চূড়ান্ত নিদর্শন। বাজপেয়ী বিজেপি নেতা হলেও তাঁর প্রশাসনে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া ছিল। তিনি নেহরু-পটেল বিরোধও বাধাতে চাননি কারণ তিনি নিজে নেহরুর ভক্ত ছিলেন। গত পাঁচ বছরে মোদীর শাসনে আবার ঐকমত্যহীন বিকাশের চিৎকার। নেহরুপুজোর পাল্টা পটেলপুজোর সঙ্কীর্ণ গা-জোয়ারির মধ্যেও অগণতান্ত্রিক অনুদারবাদের ছোঁওয়া।

আর তাই এই পাঁচ বছরে যে ভাবে আমরা–ওরার মেরুকরণের রাজনীতি দেখছি তা আগে কখনওই দেখিনি। একতার নামাবলি গায়ে এই বিভাজনের ভারত আমার দেশ না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন