Coronavirus

বদলের সম্ভাবনা সমাজ চিত্রে

একসময়ে তাঁরা ছিলেন এলাকার নয়নের মণি। আজ তাঁদের সঙ্গে সন্তানদের জীবনেও আশঙ্কার মেঘ। কী হবে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ?করোনাভাইরাস অতিমারি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধাক্কা।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২০ ০৪:১১
Share:

সংশয়ে: এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তা। ছবি: কৌশিক সাঁতরা

লক্ষ্মীপুজোর দু’দিন পরে এগরার পানিপারুলে ফুটবল উৎসব শুরু হয়। সাতদিন ধরে চলে। এলাকার বাসিন্দারা সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকেন। বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অনেকেই দুর্গাপুজোয় না ফিরে লক্ষ্মীপুজো বাড়ি ফেরেন। ফুটবল উৎসবে যোগ দেন। নির্দিষ্ট চাঁদা দেন। কেউ কেউ সেমিফাইনাল, ফাইনাল-সহ বিভিন্ন ম্যাচের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার স্পনসর করেন।

Advertisement

এটা পূর্ব মেদিনীপুরের ঘটনা। পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটাল মহকুমার দাসপুর-সোনাখালিতে দুর্গাপুজো জমজমাট। এই এলাকায় মণ্ডপের সুনাম রয়েছে। পুজোয় ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া এলাকার বাসিন্দাদের ভালরকম অবদান রয়েছে। কিন্তু এ বছর?

করোনাভাইরাস অতিমারি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধাক্কা। কিন্তু সেই ধাক্কার জেরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আরও প্রভাব পড়বে। আর তাতে হয়তো বদলে যেতে পারে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসও। ক্ষীণ-দীন হতে পারে লোক উৎসব ও সংস্কৃতির চিহ্নগুলো।

Advertisement

ঘাটালের সামাজিক বিন্যাস অনেকদিন আগে থেকেই পাল্টাতে শুরু করেছে। অবিভক্ত মেদিনীপুরে সম্ভবত এই মহকুমা থেকেই সবথেকে বেশি লোক বাইরের রাজ্যে কাজে যান। কবে থেকে তার কোনও নথি নেই। আনুমানিক আশির দশকের গোড়ার দিকে। সম্ভবত ১৯৭৮ সালে বন্যার পরপরই। শুরুতে দিল্লি, মুম্বই-সহ বাছাই কয়েকটি শহরে ঘাটাল-দাসপুরের তরুণেরা যেতেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দিল্লি-মুম্বইয়ের সঙ্গে এক এক করে অন্য রাজ্যগুলো যোগ হয়। এই মুহূর্তে দিল্লি, মুম্বই, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, কানপুর, ওড়িশা, হরিয়ানা প্রভৃতি রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এখানকার। আনুমানিক ভাবে বলা যায়, আঠারো থেকে চল্লিশ বছরের মধ্যে মহকুমার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ যুবক বাইরের রাজ্যে থাকেন। ঘাটাল মহকুমার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ সোনার কাজের উপর নির্ভরশীল।

বাসিন্দারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়ায় একদিক থেকে লাভবান হয়েছে ঘাটাল-দাসপুর। এলাকার আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে এঁদের হাত ধরেই। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও নানা ভাবে এঁদের অবদান দেখেছে ঘাটাল। ঘাটালের প্রবীণ মানুষ ও সংস্কৃতি জগতের অনেকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই স্বর্ণশিল্পীদের অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়। এঁদের হাত ধরেই দাসপুর-সোনাখালি, ঘাটালের গ্রামগুলি এগিয়ে গিয়েছে। মাটির ঘর ভেঙে প্রত্যন্ত গ্রামেও বড় বড় বাড়ি তৈরি হয়েছে। জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা, চাষে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। আবার পরোক্ষ বিনিয়োগ করে ঘাটাল-দাসপুরে জমি ব্যবসার সঙ্গে এঁদের কারও কারও যোগসূত্র রয়েছে। কয়েক মাস আগেও এঁরাই ছিলেন অহঙ্কার। তাঁদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকতেন অনেকেই। দুর্গাপুজো হোক বা শীতলা পুজো, হরিরাম সংকীর্তন থেকে মন্দির সংস্কারে তাঁদের ভূমিকা থাকত। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের ভবন তৈরিতেও এগিয়ে এসেছেন অনেকে। অনেক জায়গায় মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলের গানের আসরও বসে। দাসপুর-সোনাখালিতে ফি বছর শিবের গাজন, শীতলা পুজো উপলক্ষে গ্রামীণ নানা অনুষ্ঠানগুলো আকর্ষণীয় করে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা।

অথচ এখন? তাঁদের তকমা পরিযায়ী শ্রমিক। করোনাভাইরাস ও তার কারণে লকডাউনে কাজ হারিয়ে ফিরে আসছেন তাঁরা। এর আগেও শ্রমিকদের ফেরার ঢল দেখেছে ঘাটাল-দাসপুর। ২০১৬ সালে নোটবন্দির পর। এখন সংখ্যাটা অনেক বেশি। যে পেশার সৌজন্যে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বদল ঘটে, সেই পেশায় জনপদের কত সংখ্যক মানুষ যুক্ত-তার চুলচেরা হিসেব জনপ্রতিনিধিরা অবশ্য করার সুযোগ পাননি। তবে করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের ফেরার সংখ্যাটা দেখে অনেকেই বিস্মিত। ১ এপ্রিল থেকে ৪ জুন পর্যন্ত প্রশাসনের নথিভুক্ত ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৬ হাজারের মতো। ঘাটাল থানায় ১২ হাজার ৪৫১ জন। দাসপুরে ১৮ হাজার ৮৬১ জন। চন্দ্রকোনায় নথিভুক্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৩৮ জন। এছাড়াও লকডাউন শুরুর সময় এবং লকডাউন চলাকালীন বিভিন্ন মাধ্যমে কয়েক হাজার হাজার শ্রমিক ফিরেছিলেন। তখনকার হিসেব এখনও বাকি। এখনও প্রতিদিন মহকুমায় পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরেছেন। এঁদের প্রায় আশি ভাগ যুবক সোনার কাজে যুক্ত। অনেকে আবার সংশ্লিষ্ট সব রাজ্যে আটকেও আছেন। সেই সংখ্যাটাও কয়েক হাজার।

বাড়ি ফিরে তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকেরই। যাঁদের ‘মাথায় করে’ রাখা হত কোথাও কোথাও তাঁদের থাকতে দিতেই নারাজ গ্রামবাসীরা। কোথাও আবার থাকতে না দেওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলনও দেখতে হয়েছে তাঁদের। আর এখানেই মন ভেঙেছে তাঁদের। তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও ঘরের লোকের মতো পরিযায়ীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন এলাকার মানুষ। কিন্তু তাতে অনেকেরই ক্ষত মুছছে না। ঘাটাল-দাসপুরে বেশ কয়েকটি সরকারি নিভৃতবাস ঘুরে, কথা বলে ঘর ফেরতদের মন-মানসিকতার একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। এঁদের অনেকেই বললেন, ‘‘২০১৬ সালে ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা চিন্তা ছিল না। জানতাম, একটা সময় সোনার কারবার আবার জমবে। এখন তো একেবারে ধনেপ্রাণে মরে গেলাম।’’ আবার কারও আক্ষেপ, ‘‘ছেলে-মেয়েদের পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানে কোথায় ভর্তি করব। খরচ জোগাব কী করে বুঝে উঠতে পারছি না।’’ নিভৃতবাসে দিন কাটানোর অবসরে এঁদের অনেকেই প্রশ্ন করছিলেন, ‘‘আদৌ কি কাজের জায়গায় ফিরতে পারব? নাকি একশো দিনের কাজের উপর ভর করেই কাটবে বাকি জীবনটা?’’ কারিগরদের নিয়ে প্রশাসনের তরফে স্থানীয় স্তরে প্রশিক্ষণ দিয়ে বেকার ছেলেদের উৎসাহ দেওয়ার আগ্রহ না থাকায় একটা আক্ষেপ ছিল। সেটা এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে।

ঘরে ফেরা শ্রমিকদের আক্ষেপ যদি সত্যি হয়? তাঁদের অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে এলাকাতেই ১০০ দিনের কাজের উপরে নির্ভর করতে হয়? তাহলে তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখার বিষয়টি বড়সড় ধাক্কা খাবে। নতুন প্রজন্মের এই সমস্যায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাস পাল্টে যেতে পারে তাতে। এর সঙ্গে স্থানীয় নবীনদের কথা যদি ধরা হয় সেখানেও ধাক্কা। একে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। উৎসব, অনুষ্ঠান বন্ধ। ভবিষ্যতের অনুষ্ঠানে কোনও জৌলুসও থাকবে কি না তাতেও সংশয়। পানিপারুলে এ বছর করোনাভাইরাসের জন্য অনেকেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। খেলা নিয়ে সংশয়ে আয়োজকেরা। সংস্থার তরফে রজতকুমার বেরা জানান, লক্ষ্মীপুজোর সময় অনেকেই বাড়ি ফিরে এসে আমাদের খেলায় যোগ দেন। এই বছর খেলা আয়োজন করা যাবে কি না তা নিয়ে বেশ চিন্তায় তাঁরা। ফলে পাড়ার ঘরবন্দি কিশোর-তরুণদের বঞ্চিত হতে হবে।

এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি শোধরানোর কোনও ইঙ্গিত নেই। এই অবস্থায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বদল নিয়ে ঘরে ফেরাদের মাথাব্যথা নেই। তাঁদের কারও কারও একটাই কথা, ‘‘মাথায় থাক মা দুর্গা, শিবের গাজন, খেলা। এখন আমরা কী খাব, কী করব সেটা নিয়েই ভেবে চলেছি।’’

তথ্য সহায়তা: সৌমেশ্বর মণ্ডল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement