প্রবন্ধ ১

অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন

মধ্য এশিয়ার সঙ্গে কাশ্মীরের বহু শতকের যোগাযোগ। তবু্ আজ দিল্লি, লাহৌর, ইসলামাবাদের মধ্যে যাতায়াত করা গেলেও শ্রীনগর থেকে পাক কাশ্মীরের মুজফফরাবাদ পর্যন্ত ১৭৯ কিলোমিটার পথ পেরোনো অসম্ভব, অবাস্তব।স ম্প্রতি ভারত থেকে সাংবাদিকদের একটি দল কাশ্মীর থেকে মুজফফরাবাদ গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বা নিয়ন্ত্রণরেখার দুই দিকের মানুষের মধ্যে মৈত্রী বন্ধনের চেষ্টা। কিছু অল্পবয়সি সাংবাদিক ছিলেন এঁদের মধ্যে, যাঁরা ও পারে যাওয়ার সুযোগ পেলেন প্রথম বার। মুজফফরাবাদের সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাবের কানায় কানায় ভর্তি হলটিতে দেখা গেল, তাঁদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।

Advertisement

সুজাত বুখারি

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ছিন্নমূল। গুলিবিনিময় থেকে বাঁচতে। ও-পারের কাশ্মীর। অগস্ট ২০১৫। ছবি: এএফপি

স ম্প্রতি ভারত থেকে সাংবাদিকদের একটি দল কাশ্মীর থেকে মুজফফরাবাদ গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বা নিয়ন্ত্রণরেখার দুই দিকের মানুষের মধ্যে মৈত্রী বন্ধনের চেষ্টা। কিছু অল্পবয়সি সাংবাদিক ছিলেন এঁদের মধ্যে, যাঁরা ও পারে যাওয়ার সুযোগ পেলেন প্রথম বার। মুজফফরাবাদের সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাবের কানায় কানায় ভর্তি হলটিতে দেখা গেল, তাঁদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তরুণ গায়ক বানো রহমতের উদাত্ত গান তাঁদের ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কেবল সেই কারণেই কান্না নয়। দশকের পর দশক ধরে অকারণ এক রাজনৈতিক ক্ষত কী ভাবে দুই দিকে ক্রমাগত রক্ত ঝরিয়ে চলেছে, সেটা তাঁরা নিজেদের শরীরে মনে অনুভব করছিলেন। কোনও সাধারণ অনুভূতি নয় সেটা।
বানোর গম্ভীর সুরেলা কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল, ‘অ্যায় ওয়াতন তেরি জানাত মে আয়েঙ্গে এক দিন’ (আমার দেশও এক দিন এসে পৌঁছবে তোমার স্বর্গে) ঠিক কী আবেগের ঢেউ তুলছিল ওই তরুণদের মধ্যে, বলে বোঝানো যাবে না। কেবল ভারতীয় সাংবাদিকরা নন, দেখছিলাম, শ্রোতাদের অনেকেই অঝোরে কাঁদছেন, কেঁদেই চলেছেন। এ এমন এক আবেগ, একমাত্র বিচ্ছেদব্যথাই যাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, এক সুদীর্ঘ সুব্যাপ্ত বিচ্ছেদ, লক্ষ লক্ষ পরিবারের মধ্যে কত দিন, কত বছর ধরে ঘটে যাওয়া বিচ্ছেদ।
২০০৫ সালে শ্রীনগর-মুজফফরাবাদ আর পুঞ্চ-রাওয়ালকোট বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় এলওসি-র এ পারে ও পারে অনেকেই পরস্পরকে খুঁজে পেয়েছিলেন পাঁচ দশক বাদে। ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ অর্থাৎ পারস্পরিক আস্থা নির্মাণের উদ্যোগের অংশ হিসেবে চলে এই বাস সার্ভিস। কিন্তু এটাও ঠিক, এই বিচ্ছেদ কেবল পারিবারিক নয়, একটা গভীর রাজনৈতিক আবেগও এতে আছে। এ বারের কথাই ধরা যাক। বারো জন সাংবাদিকের দল যখন তথাকথিত পাক জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম শহর কোহালা পৌঁছলেন, সকলেই প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত! খচখচ ছবি তুলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন, সমানে একই আলোচনা করছেন: এই অঞ্চল কিছু দিন আগেও তাঁদেরই দেশ ছিল, তাঁদের নিজস্ব কাশ্মীর।
জম্মু ও কাশ্মীর দুই নয়, তিন টুকরোয় ভাগ হয়ে গেছে। একটি ভাগ ভারতে, একটি পাকিস্তানে, একটি চিনে। কিন্তু পাকিস্তান সীমান্তের কাছেই আবেগ সবচেয়ে তীব্র। আজও দুই দিকের কাশ্মীরিদের মনের মধ্যেই যন্ত্রণার পাহাড়, আর তার চেয়েও বেশি করে, কোনও না কোনও সময় আবার মিলিত হওয়ার অদম্য স্বপ্ন।
আমাদের দল যখন ঝিলম ও নিলম (ভারতের মধ্যে যার নাম কিষানগঙ্গা)-এর মোহনায় অবস্থিত শহর দোমাইল পৌঁছল, একটা অন্য ধরনের আবেগে ভাসলাম আমরা। রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে লেখা ‘শ্রীনগর ১৭৯ কিলোমিটার, কাবুল ৩৯৩, তাসকেন্ট ৫৭৮।’ প্রত্যেকের মাথায় বিদ্যুতের মতো একটাই কথা খেলে গেল। এত দূরের লোকেরা এত কাছের? আর আমরা কেউ নই? দিল্লি, লাহৌর, ইসলামাবাদের মধ্যে যাতায়াত করে কত লোক, কিন্তু এই ১৭৯ কিলোমিটার যাত্রা এতই অবাস্তব, এত অসম্ভব। বুকে যেন ব্যথা করে উঠল। কাবুল ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে কাশ্মীরের যোগাযোগ তো কত পুরনো, সেই মধ্যযুগ থেকে, কতগুলো শতক ধরে এখানকার বাণিজ্যপথ দিয়ে যাতায়াত করেছে অগণন মানুষ। তখনও যে আসাযাওয়া সহজ ছিল, বিশ-একুশ শতকের আধুনিক দুনিয়ায় সেটা এত কঠিন হয়ে গেল? ১৯৩০ পর্যন্ত কাশ্মীরের সঙ্গে সিল্ক রুটের সংযোগ ছিল প্রাত্যহিক। ১৯৪৯ সাল অবধিও সেটা টিমটিম করে থেকে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে কাশ্মীরিদের কাছে মুজফফরাবাদ শহরই ছিল মধ্য এশিয়া, তথা অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান দরজা, ১৯৪৭ সালের আগে এই বাস্তবের একটুও পরিবর্তন হয়নি। আর আজ? কেবল সুদূর নয়, মুজফফরাবাদ এক অগম্য ভূমি।

Advertisement

কাশ্মীরিদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগ ছিল তাজিকিস্তানের। তার যাত্রাপথও এটাই। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাধক মীর সৈয়দ আলি হামদানির সমাধি এখানকারই কোলাব শহরে। হামদানির আর এক নাম আমীর-ই-কবীর, কাশ্মীর ও অন্যত্র বহু মানুষের ইসলামে শরণ নেওয়ার কারণ তিনিই। কাশ্মীরিদের অসীম ভক্তির পাত্র তিনি। সুতরাং এই পথ সত্যি আবার কোনও দিন খুললে, কাশ্মীরিরা আবারও তাঁদের তীর্থযাত্রার দিশা পাবেন, একটা অত্যুন্নত সভ্যতার সঙ্গে নিজেদের আবার যুক্ত করতে পারবেন। মুশকিল হল, অন্যরা পছন্দ করুক না করুক, কাশ্মীরিদের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা বাঁধন আছেই, ধর্মের বাঁধন, সংস্কৃতির বাঁধন, সভ্যতারও বাঁধন। ওই দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধন কাশ্মীরিরা চাইবেন কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। অনেক কাশ্মীরি নিশ্চয়ই চাইবেন না। কিন্তু আবেগগত ও সমাজগত ভাবে যে একটা প্রবল টান দু’দিকেই আছে, এই সত্যটা অস্বীকার করা কিন্তু বোকামি হবে। গত কয়েক দশকে কাশ্মীরে যে পাকিস্তান-পাকিস্তান আবেগটা কমে আসছিল, ২০০৮-এর পর দিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আবার জ্বলে উঠছে। দূরত্বের যন্ত্রণাটাও বাড়ছে।

সাংবাদিকদের দল এ বার পাকিস্তান বিষয়ে একটা ধারণা পেলেন। সে দেশের কাশ্মীর নীতি, কাশ্মীরিদের প্রতি ব্যবহার ইত্যাদি দেখলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক যখন বাতিল হল, সেই সময়ই এই এলওসি সফর। ফলে চার দিকে একটা হতাশার ঘন কুয়াশা। গোটা পাকিস্তান জুড়ে চলছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুণ্ডপাত। প্রচারমাধ্যমে এবং লোকের মুখে মুখে একই কথা, ‘নওয়াজ শরিফ চেষ্টা করেছিলেন, মোদী নষ্ট করে দিলেন।’

Advertisement

ভারত পাকিস্তান উভয় দিকের কাশ্মীরিরা একই রকম উৎসাহিত ছিলেন মুজফফরাবাদ দেখতে। কিন্তু যাওয়ার পর বোঝা গেল, যেমন ভাবা হয়েছিল, এ ঠিক সেই মুজফফরাবাদ নয়। ২০০৫ সালের ভূমিকম্প বিপর্যয়ের আগেও এই জায়গায় গিয়েছি আমি, পরেও গিয়েছি। কিন্তু আজকের পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের (এটা ভারতের তরফে দেওয়া নাম। একই অঞ্চলকে পাকিস্তানে বলা হয় আজাদ কাশ্মীর) রাজধানী মুজফফরাবাদ অনেকখানি আলাদা। চার দিকে একটা অন্য প্রভাব। প্রতিটি মিনার বা গম্বুজের মধ্যে তুর্কি স্থাপত্য অয়াসোফিয়া-র অভ্রান্ত ছাপ। সবুজ অরণ্য-ঘেরা পাহাড়ের কোলে পরিষ্কার রাস্তা, সুন্দর বাড়িঘর। পাকিস্তান যে এই জায়গাটার যত্ন নেয়, তার ছাপ। আমাদের অনেকেই জানি, এই অঞ্চল আসলে এখনও দখল-করা অঞ্চল, স্বাভাবিক মুক্তির স্বাদ এখানে নেই। কিন্তু সে কথা শুনছে কে। ফেরার পর রিপোর্টারদের তোলা ছবি আর ভিডিয়ো দেখে অনেকেই বিস্ময়ে ঈর্ষায় দিশেহারা: ‘এগুলো কি সত্যি ছবি, না বানানো?’

চার দিকে যে একটা অব্যক্ত ভয়ের পরিবেশ, সেটা ধরতে অবশ্য আমাদের ভুল হয়নি। বাইরের লোক দেখলেই কেউ কথা বলতে চায় না। রাজনৈতিক নেতারাও তাই। অনেক কাল ধরেই দেখছি এটা। তবু বলব, ভয়টাও আগের চেয়ে খানিক কম মনে হল এ বার।

সাংবাদিকদের এই সফরটির খুবই দরকার ছিল। মানুষের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি ছাড়া দুই দিকের পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি মেটানো অসম্ভব। মানুষের যন্ত্রণা কমাতেও এই ধরনের সফর সাহায্য করে, যাকে ছোট করে দেখা ঠিক নয়। হাজার হাজার কাঁটাতার, সিমেন্ট আর বন্দুক যে কাজ করতে পারেনি, দুই দেশের পাশাপাশি থাকার উপযোগী পরিবেশটুকুও তৈরি করতে পারেনি, হয়তো সেটা করতে পারবে। অন্য দিকটিকে দেখতে পেলেই ক্রমে ক্ষতের উপশম হবে, যন্ত্রণা কমবে, সম্প্রীতি জাগবে। এই ধরনের কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স (সিবিএম) যে কাজটা করতে পারে, কোনও রাজনীতি তা পারে না। বস্তুত সিবিএম-ই রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করার একমাত্র পথ।

মুজফফরাবাদে গিয়ে মনে হয়, ভারত পাকিস্তানের যা হয় হোক, সীমান্তের দুই দিকের কাশ্মীর যে একটি অভিন্ন অঞ্চল, তাতে সন্দেহ চলে না। এত দিনের বিচ্ছেদেও এই ঐক্যে একটুও চিড় ধরেনি। যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রবল দোষারোপের চাপান-উতোর, তখনও এই অঞ্চলে আশার হাওয়া ভাসছে পাহাড়ে পাহাড়ে: হয়তো কিছু একটা হবে। হয়তো দুই দেশ কোনও ভাবে এই অঞ্চলের প্রতি তাদের দায় পূরণ করতে পারবে।

মনে পড়ছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদী গত বছর সার্ক মিটিং-এ একটা কথা বলেছিলেন। ‘উন্নতির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমরা যেন না ভুলি যে ভাল থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়েই যাঁরা বাঁচছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।’ মোদী এমনকী সীমান্তের কথাও বলেছিলেন সেখানে। বলেছিলেন, সীমানা জিনিসটা অর্থহীন হয়ে আসছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে। তাঁর কি মনে আছে এ সব? কাশ্মীরের কিন্তু মনে আছে। দুই দিকের কাশ্মীরেরই। পরস্পরের সঙ্গে সুখ দুঃখ সমস্যা সমাধান সব কিছু ভাগ করে নেওয়ার জন্য যারা এত দিন ধরে অপেক্ষায়, তাদের জন্য কিছু করার আছে নিশ্চয়ই। কে করবে সে কাজ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন