ঐতিহ্য কাহাকে বলে? যাহা লইয়া বড়াই করিতে সকলে উদ্গ্রীব, কিন্তু যত্ন করিতে কেহ আগ্রহী নহে, এ পোড়া বঙ্গদেশে তাহাকেই বলে ঐতিহ্য। শিল্প-সাহিত্য খুঁজিবার প্রয়োজন নাই, চিরপরিচিত খেজুরগুড়ের দিকে তাকাইলেই যথেষ্ট। খেজুরগাছ নাই, খেজুরগুড়ও নাই। দুধের বদলে পিটুলিগোলার ন্যায় বাঙালি এখন খেজুর পাটালি বলিয়া ভেলিগুড়ের চাকতি খাইতেছে। বাঙালির প্রিয় কবি সুকুমার রায় দুনিয়ার সকল ভাল জিনিসের তালিকা করিয়া পাউরুটি আর ঝোলাগুড়কে সেরার শিরোপা দিয়াছিলেন। অতঃপর প্রতি প্রজন্মে বাঙালি সেই শংসাপত্রে ছাপ দিয়াছে। পাটিসাপটা, সরুচাকলির গায়ে তরল নকশা কাটিয়া, পিঠার থালির সহিত বাটি ভরাইয়া, রসগোল্লা-সন্দেশ সুরঞ্জিত ও সুরভিত করিয়া খেজুরগুড়ের আবির্ভাব। গরম রুটির সহিত খেজুর-পাটালির টুকরাটি হরিপদ কেরানিকেও আকবর বাদশা করিয়া তোলে। গুড় নহিলে বাঙালির নবান্ন, পৌষ-পার্বণ হয় না, গুড় না থাকিলে খোকার হাতের মোয়াটিও অদৃশ্য হয়। কালের নিয়মে জনজীবন শহরমুখী হইয়াছে, ভূরিভোজের পাতে বৈচিত্র বাড়িয়াছে, কিন্তু গুড়ের সমাদর কমে নাই। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের অভিজাত বঙ্গললনা সিসি-লিসি প্লাম পুডিং অপেক্ষা পিঠাপুলিতে অধিক প্রলুব্ধ ছিল। এ কালও তাহার ব্যতিক্রম নহে। বরং কখনও স্যুফ্লে, কখনও আইসক্রিম, নব নব রূপে অবতীর্ণ হইতেছে খেজুরগুড়।
সেই অমৃত নিশ্চিহ্ন হইবার পথে। খেজুর গাছ কাটিয়া শেষ করা হইয়াছে, শিউলির কাজে নবীন প্রজন্মের তালিম নাই, আগ্রহও নাই, গুড় বানাইবার কারিগররাও ক্রমে নিশ্চিহ্ন হইতেছে। কর্কশ বৃক্ষ হইতে অমৃত নিষ্কাশনের মন্ত্র কে শিখিবে? সংবাদে প্রকাশ, ভেলিগুড় ও চিনির মিশ্রণকে চায়ে রাঙাইয়া, তাহাতে কৃত্রিম সুগন্ধী দিয়া নকল পাটালি প্রস্তুত হইতেছে। নীরদচন্দ্র যথার্থই বলিয়াছিলেন, বাঙালি আত্মবিস্মৃত। হয়তো একবিংশের বঙ্গসমাজ ইউনেস্কোর শংসাপত্রের জন্য অপেক্ষা করিতেছে। বিদেশ হইতে ‘হেরিটেজ’ তকমা না মিলিলে এ দেশে কোনও কিছুই সংরক্ষণের উপযোগী বলিয়া গণ্য হয় না। অনাদরে, অন্যমনস্কতায় ঐতিহ্য-বিদায়ের অবিচ্ছিন্ন ধারা চলিতেছে স্থাপত্য-হস্তশিল্প-রসনাশিল্পে।
কিন্তু গাছ হইতে রস, এবং রস হইতে গুড় পাইবার প্রক্রিয়াটি এক জীবন্ত, চলমান ঐতিহ্য। তাহা হারাইলে একেবারেই হারাইবে। নরেন্দ্র মিত্রের ‘রস’ গল্পটিতে রস আহরণকারী শিউলি রাতের ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তগুলিতে তাহার স্ত্রীকে শোনায় তরল রস জ্বাল দিয়া সুরভিত পাটালি করিয়া তুলিবার কৌশল। ডিগ্রি-ডিপ্লোমাহীন মানুষেরা সামান্য প্রযুক্তির ব্যবহারে গুড় বানাইয়া থাকেন। তাই সে কাজটি অপ্রশিক্ষিত, অসংগঠিত শিল্পের শ্রেণিতে স্থান পাইয়াছে। অথচ রস আহরণ হইতে গুড় প্রস্তুতির প্রতিটি ধাপে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা, বিশেষ কুশলতা ও প্রায়োগিক জ্ঞান প্রয়োজন। গুড় প্রস্তুতির প্রশিক্ষণের ধারা হারাইলে আর ফিরিবে না। দরিদ্র পরিবারগুলি এই জ্ঞানের ধারক-বাহক, তাই তাহার যথেষ্ট সমাদর কখনও করে নাই ভদ্রসমাজ। নচেৎ আজ সরকারি প্রকল্পে মাটি কাটিবার কাজ অধিক আকর্ষণীয় মনে হইত না গুড়শিল্পীর সন্তানের।