প্রধানমন্ত্রী যে কেবল শাসক দলের নেতা নহেন, দেশের শীর্ষ শাসক হিসাবে তিনি দলমতের ঊর্ধ্বে— বেশ কিছু বিরোধী কংগ্রেস নেতার সৌজন্যে এই কথা দেশের নাগরিক সমাজের স্মরণ করিবার অবকাশ ঘটিল। দেশের ভিতরে যতই দলে দলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে লড়াই চলুক, দেশের বাহিরে সেই সব লড়াই ভুলিয়া ভারতের সম্মান ও স্বার্থই যে আগে, তাঁহারা মনে করাইয়া দিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাঁহারা কঠোর ভাষায় বার্তা পাঠাইয়াছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রুপ করা হইতে তিনি বিরত হউন— আফগানিস্তানে ভারতের করণীয় কী, সে বিষয়ে মার্কিন উপদেশ বা রঙ্গরসিকতা ভারতের প্রয়োজন নাই। প্রসঙ্গত, ট্রাম্প কয়েক দিন আগে বক্তৃতার সময়ে তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর সহিত বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটাইয়া তিনি কেবল এইটুকুই জানিতে পারিয়াছিলেন যে ভারত সরকার আফগানিস্তানে একটি গ্রন্থাগার নির্মাণের কথা ভাবিতেছে— যে বাক্যের পর ট্রাম্পের তির্যক সংযোজন— যদিও আফগানিস্তানে কে বা কাহারা গ্রন্থাগার ব্যবহার করিবে, তাহা তিনি ঠিক জানেন না! অর্থাৎ দীর্ঘ কালের কূটনৈতিক মিত্র দেশ আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ও আদানপ্রদান বিষয়ে প্রায় কিছুই না জানিয়া কোনও বাহির-দেশের দেশনেতা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করিলেন। বিরোধী নেতাদের তরফে সরকারকে উপদেশ: সড়ক, জলাধার নির্মাণ বা বিবিধ উন্নয়নমূলক কাজে আফগানিস্তানকে ভারত যে ঘনিষ্ঠ সহায়তা করে, সে কথা প্রচার করুক তাহারা। তবে, এখানে এই প্রচারের অপেক্ষা গুরুতর— প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় পরিচিতি ঊর্ধ্বে রাখিবার বক্তব্যটিকে গুরুত্বপূর্ণ করিবার প্রয়াস। অবশ্যই সে প্রয়াস রাজনৈতিক। কিন্তু রাজনৈতিক বলিয়াই তাহা অবহেলাযোগ্য নহে। কখনও কখনও শুভ উদ্দেশ্যেও রাজনৈতিক প্রয়াস করা যায়— কংগ্রেস মনে করাইল।
ঘটনাটি গুরুতর এই জন্য প্রধানমন্ত্রী যে কেবল শাসক দলের নেতা নহেন, দেশের শীর্ষ শাসক হিসাবে দলমতের ঊর্ধ্বে বিরাজমান নেতা, সে কথা ভারতবাসীকে গত কয়েক বৎসরে ভুলাইয়া দিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী মোদীই। প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দলীয় নেতার ভূমিকাটি তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন, সমগ্র দেশের শাসকের ভূমিকাটি বিস্মৃত হইয়া। তাই বিদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া অদৃষ্টপূর্ব ভাবে তিনি বিরোধী দলগুলির তীব্র সমালোচনা করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আদানপ্রদানে নিয়মিত ভাবে বিস্মৃত হন যে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একটি গুরুতর দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক চালনা করিতেছেন। বদলে, তাঁহার ভাবটি দাঁড়ায় যে তিনি নিজের দলের সমর্থকদের লক্ষ্য করিয়া পাকিস্তানকে ‘শিক্ষা’ দিতেছেন। অর্থনীতির সংস্কারের ক্ষেত্রেও বারংবার তাঁহার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হইয়াছে দলীয় স্বার্থের প্রাবল্যে, জাতীয় স্বার্থ ডুবিয়াছে পিছনে। তাঁহার নিজের দলের সতীর্থ যশবন্ত সিন্হাই মন্তব্য করিয়াছেন, নরেন্দ্র মোদী যে হেতু মনে রাখেন নাই যে সরকারের কোনও রং থাকে না, তাই তাহার কোনও বিভাজনরেখাও থাকে না— বার বার পূর্বতন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করিবার তৎপরতায় মোদী দেশকে অসম্মান করিয়াছেন। সুতরাং, রণদীপ সুরজেওয়ালা বা আহমেদ পটেলরা মোদীর প্রতি একটি তির হানিলেন। রাজনৈতিক তির। সুস্থ রাজনীতির তির।