ভোটের দায় বড় দায়, তবু তাহার জন্য সর্বৈব দায়িত্বজ্ঞানশূন্য হইয়া পড়া যায় না। বিশেষত দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি বিধানসভা ভোটের জন্য দায়িত্বজ্ঞানের সকল সীমা-পরিসীমা ছাড়াইয়া উদ্ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন গুজব ছড়াইতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি গুজরাত ভোটে পাকিস্তানের সহিত কংগ্রেসের সংযোগ লইয়া যে সব মন্তব্য করিয়াছেন, কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান (মুসলিম) মুখপাত্র আহমেদ পটেলকে নাকি পাকিস্তান পরবর্তী শীর্ষনেতা হিসাবে নিভৃতে মনোনীত করিয়াছে, এই মর্মে যে অভিযোগ তুলিয়াছেন— তাহার সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণসাবুদ যদি তাঁহার নিকট থাকে, তবে তাহা এখনই জনসমক্ষে প্রকাশ করা কর্তব্য। আর যদি সে সকল প্রমাণ না থাকে, এই অভিযোগ যদি কেবলই আন্দাজনির্ভর গুজবের পর্যায়ে পড়ে, তবে বলিতে হইবে, প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ পদে বসিয়া দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ লইয়া তিনি অতি বিপজ্জনক ছেলেখেলা করিতেছেন। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন নজির অদৃষ্টপূর্ব। পাক-সীমান্তবর্তী রাজ্যের ভোট লইয়া এমন অভিযোগ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ-ব্যতিরেকে উত্থাপন করিলে, তাহা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। দেশের সবচেয়ে দায়িত্বশীল পদে বসিয়া দেশের মানুষকে ঠকানোর পর্যায়ে পড়ে। ইহা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমতার প্রশ্ন, মর্যাদার প্রশ্ন, নিরাপত্তার প্রশ্ন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হইবার পর গোড়া হইতেই পদটির মাহাত্ম্যের প্রতি যথেষ্ট মর্যাদা দেখান নাই। তাঁহার আচরণ ও ভাবভঙ্গি দলীয় নেতার স্তর ছাড়িয়া প্রধানমন্ত্রীযোগ্য হইয়া ওঠে নাই। হয়তো প্রধানমন্ত্রীযোগ্য ব্যবহার বলিতে ঠিক কী বোঝায়, সে বিষয়েও তিনি তেমন অবগত নন। তিনি বিজেপির নেতা, এইটুকুই, দেশের নেতা হইবার ধৈর্য ও মর্যাদাবোধ তাঁহার নাই। গুজরাতের ভোট-প্রচার জুড়িয়া তাঁহাকে ক্রমাগত ব্যক্তিগত কুৎসা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ অভিযোগ নিক্ষেপে নিজেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখিতে দেখা গিয়াছে, আর কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রম বা ভাবনাচিন্তার ইঙ্গিত তিনি দেন নাই। নির্বাচনের আগে দলীয় দশা গোলমেলে দেখিয়া দলের একমাত্র মুখ নরেন্দ্র মোদী পরিকল্পনামাফিক সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাত্রা কয়েক গুণ চড়াইয়া দিয়াছেন, আর সেই অপপ্রচারের প্রধান দায়িত্ব লইয়াছেন নিজে। এ বারের পাকিস্তান-মন্তব্যও মেরুকরণের লক্ষ্যেই নিবেদিত। কংগ্রেসকে মুসলিম ও পাকিস্তান প্রশ্নে দাগাইয়া দিয়া তাহাকে দেশের শত্রু হিসাবে প্রতিপন্ন করাই তাঁহার উদ্দেশ্য।
আরও একটি ঘোর অন্যায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী করিয়াছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ইহার মধ্যে টানিয়া আনিয়া। মনমোহন সিংহের বিরুদ্ধে তাঁহার যত ক্ষোভই থাকুক না কেন, তিনি পাকিস্তানের ভূতপূর্ব বিদেশমন্ত্রীর সহিত ‘গোপন’ বৈঠক করিয়াছেন— এমন একটি অভিযোগে তাঁহাকে জড়াইবার আগে প্রমাণাদি পেশ করা উচিত ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ‘যে কোনও’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, দীর্ঘ কাল তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত থাকিয়াছেন, তাঁহার হাতে দেশের সর্বময় প্রশাসন-কর্তৃত্ব থাকিয়াছে, ফলত পাকিস্তানের সহিত তাঁহার গোপন যোগাযোগের ইঙ্গিত গোটা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের নিকটই গুরুত্ববহ। গুজরাত ভোটের ফলাফল যাহাই হউক না কেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চক্ষুলজ্জাহীন অবিমৃশ্যকারিতা গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারপর্বকে দেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় করিয়া রাখিল। মনমোহন সিংহ তাঁহার বিরুদ্ধে মোদীর অভিযোগ শুনিয়া স্বভাবতই মর্মাহত। তিনি কঠোর ভাষায় সেই অভিযোেগর প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং ক্ষমা চাহিবার দাবি জানাইয়াছেন। সংগত দাবি। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই দাবি পূরণ করিবেন— মনমোহন নিজেও বোধ করি এমন ভরসা করেন না।