Bisva Bharati

ঐতিহ্য বনাম জমির মালিকানা

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজের পাশপাশি, শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, তার জীবনশৈলীকে রক্ষা করা যে বিশ্বভারতীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, এটা কাউকে আলাদা করে বলতে হত না। 

Advertisement

অশোক সরকার

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২০ ০০:০৫
Share:

শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা ও মেলার মাঠের পাঁচিল নিয়ে বিতর্ক আসলে দুটো অধিকারের মধ্যে তর্ক— সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, আর জমির মালিকানার অধিকার।

Advertisement

১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রমের জন্য যে ট্রাস্ট তৈরি করেছিলেন, সেই শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের কয়েকটি কাজের মধ্যে ছিল বৎসরান্তে এক বার মেলা করা, আর একটা স্কুল স্থাপনের কথা। সেই অনুযায়ী ১৮৯৬ সাল থেকে পৌষমেলা শুরু হয়। তখন পাঠভবন ছিল না, বিশ্বভারতী ছিল না, ছিল শান্তিনিকেতন আশ্রম। সেই আশ্রমই পৌষমেলা করে এসেছে কয়েক যুগ ধরে। ৭ পৌষের অনুষ্ঠানটি ১৮৯১ সালে শুরু হয়েছিল, সেটি ছিল আশ্রমেরই অনুষ্ঠান। ১৮৯২ সাল থেকে বুধবারের মন্দির, ১৮৯৩ সাল থেকে বাজি পোড়ানো— এ সবই ছিল আশ্রমের অনুষ্ঠান। সেই আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী আজও আমিষ নিষিদ্ধ, শান্তিনিকেতনের আঙিনায় মূর্তি পূজা বারণ। তার অনেকটাই আজও মেনে চলা হয়। আশ্রমের ছোট গণ্ডি ছাড়িয়ে শান্তিনিকেতন বেড়ে উঠেছিল ব্রহ্মবিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর হাত ধরে; তার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতনের একটি নিজস্ব জীবনশৈলীর পরিচয় ও সুনাম গড়ে উঠেছিল। সেই জীবনশৈলীর মধ্যে জামাকাপড়, সাজসজ্জা, চলাফেরা, সম্বোধন, যানবাহন, আসবাব, ঘর সাজানো, আলপনা, স্থাপত্য থেকে বসন্তোৎসব, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব, ৭ পৌষের অনুষ্ঠান, পৌষমেলা সবই আসে।

১৯২১ সালে বিশ্বভারতী তৈরি হওয়ার পরেও বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের মধ্যে তফাতটি কী, সেটা সবাই বুঝতেন। শান্তিনিকেতন যে একটা জীবনশৈলীর ধারক, আর কলাভবন-বিদ্যাভবন-শিক্ষাভবন-শ্রীনিকেতন ও পরে অন্যান্য ভবনকে নিয়ে বিশ্বভারতী একটা বিশেষ জ্ঞান ও বিদ্যা শৈলীর বাহক, এই তফাতটা স্পষ্ট ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজের পাশপাশি, শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, তার জীবনশৈলীকে রক্ষা করা যে বিশ্বভারতীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, এটা কাউকে আলাদা করে বলতে হত না।

Advertisement

পাঁচিল নিয়ে জলঘোলার কাহিনিটিও অনেক দিনের। নকশাল আমলে উত্তরায়ণ ও নন্দন চত্বর সুরক্ষিত করার জন্য ঘিরে দেওয়ার কথা উঠেছিল। সিমেন্ট কংক্রিটের পাঁচিল না তারের বেড়া, এই নিয়ে অনেক বাগ্‌বিতণ্ডার পর তারের বেড়াতেই সবাই সায় দেন। মনে রাখা ভাল, বিষয়টা ছিল সুরক্ষার, সীমানার নয়। কিন্তু ২০০৪ সালে নোবেল পুরস্কার চুরি যাওয়ার পর আবার সুরক্ষার প্রশ্নটি সামনে আসে। তার সঙ্গে সামনে আসে বিশ্বভারতীর জমির পরিমাণ ও সীমানার প্রশ্নটি। দেখা যায়, বিশ্বভারতীর জমির কোনও ম্যাপ নেই। ২০০৭ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনের ম্যাপ তৈরি হয় ও জমির রেকর্ড আপডেট হয়, এবং তখন থেকেই বিশ্বভারতীর ভিতরে পাঁচিলের দাবি তৈরি হতে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাস বার বার প্রমাণ করেছে, ম্যাপ ও রেকর্ড, জমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।

জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সীমানা চিহ্নিত করতে হয়। সীমানা চিহ্নিত করার নানা সাংস্কৃতিক রূপ আছে— আল, খুঁটি, গাছের বেড়া, বাঁশের বেড়া, তারের বেড়া, পরিখা, সিমেন্ট-কংক্রিট। শান্তিনিকেতনে জমির সীমানার নানা সাংস্কৃতিক রূপ দেখা যায়— টগর প্রভৃতি গাছের বেড়া, অল্প উচ্চতার লোহার বেড়া, তারের বেড়া, ইত্যাদি। পশ্চিমি শহর সভ্যতার প্রতীক সিমেন্ট-কংক্রিট; দেশ যেখানে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফিরে পেতে চাইছে, সেখানে শান্তিনিকেতনের মানুষজন তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও তার প্রতিষ্ঠার দাবি তুলবেন, এটাই যথার্থ।

সংবিধানে বলা আছে, দেশের নাগরিকদের যে কোনও অংশ তাঁদের ভাষা, লিপি অথবা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকার পাবেন। শান্তিনিকেতনের মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে; সেই ঐতিহ্য জমির অধিকার রক্ষায় সায় দেয়, সিমেন্ট-কংক্রিটের পাঁচিল সেই সংস্কৃতির বাহক নয়।

মহর্ষি মেলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে। সেই ট্রাস্ট আজও টাকা নিয়ে মেলার মাঠের জমি পৌষমেলার ৩-৪ দিনের জন্য ভাড়া দেয়, সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য টাকা নেয়। আর বর্তমান মেলার মাঠের জমিটা ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনে অধিগৃহীত জমি, ১৯৪৬ সালে। সরকার অধিগ্রহণ করে বিশ্বভারতী সোসাইটিকে দিয়েছিল। জমি অধিগ্রহণের নিয়ম অনুযায়ী ‘জনস্বার্থ’ ঘোষণা করতে হয়েছিল— চাষবাস, শিক্ষা, জলসরবরাহ। মেলার কথা সেখানে নেই, কারণ মেলা তখন ওই মাঠে হত না। হত কাচের মন্দিরের সামনের মাঠে।

পৌষমেলা জনস্বার্থেরই কাজ। সেই জনস্বার্থের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কোনও বিরোধ নেই; জমির সীমানা নির্দেশের যে সব পরিচিত রূপ শান্তিনিকেতনে আছে, তারও বিরোধ নেই। হিরে-জহরত রক্ষা করতে দুর্গের পাঁচিল লাগে, জমির সীমানা চিহ্নিত করতে নয়।

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন