রাজনীতিকে ব্যক্তি থেকে নীতির প্রশ্নে নিয়ে যাওয়া জরুরি

জোটের নির্দিষ্ট কর্মসূচি চাই

ক’দিন আগেও যা ছিল অ্যান্টি-ন্যাশনাল, তাই এখন ‘আরবান নকশাল’। জাতীয়তাবাদ বিষয়টি এখন আর বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। যাঁদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী ওই সুখস্বপ্ন রচনার চেষ্টা হয়েছে, তাঁরা, অর্থাৎ হিন্দুরাই, এখন দ্বিধাবিভক্ত

Advertisement

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৪৬
Share:

সমষ্টি: প্রতিবাদ কর্মসূচিতে একত্র হয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি, দীনেশ ত্রিবেদী, শরদ যাদব, রাহুল গাঁধী, তেজস্বীপ্রসাদ যাদব ও ডি রাজা

একটা কথা বার বার শুনছি। মোদীর যোগ্য বিরোধী নেতা কোথায়, যিনি সর্বভারতীয় স্তরে মোদী তথা বিজেপির মোকাবিলা করতে সক্ষম? অনেকের মতেই নেতৃত্বের প্রশ্নে ব্যক্তি মোদী অনেক এগিয়ে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নেওয়া জনমত-সমীক্ষার ইঙ্গিত হল, ওই রাজ্যগুলিতে বিজেপি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারালেও প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে ব্যক্তি মোদী রাহুল গাঁধীর তুলনায় জনপ্রিয়। একই সঙ্গে মানুষ দলীয় সরকারের বাধ্যবাধকতা ও ব্যক্তি নেতার মূল্যায়ন করতে সক্ষম হচ্ছেন, আশ্চর্য বটে।

Advertisement

এটি তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তিটি দাপুটে হন। কোনও বিশেষ সরকারি নীতি সেখানে মানুষের কাছে গুরুত্ব পায় না। সাধারণ মানুষ ভাবতে ভালবাসেন যে ওই ব্যক্তি তাঁদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন, তাঁর রাজনীতি যা-ই হোক। ২০১৪-র নির্বাচনের আগে এই পাতায় আমি লিখেছিলাম যে মোদী এগিয়ে, কারণ অত্যন্ত সচেতন ভাবে একটি অরাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা চলছে, যেখানে ব্যক্তির দাপটই প্রধান হয়ে উঠবে (আবাপ, ১ এপ্রিল ২০১৪)। বিগত সাড়ে চার বছরের অভিজ্ঞতা এই খাতেই বয়েছে।

যখন নির্দিষ্ট করে কিছু চাওয়ার নেই, তখনই মানুষ একটি মহাশক্তিধর ব্যক্তিগত বিকল্প চান। অর্থাৎ সুখের ঘরে বাতি নিভলেও আঁধার ঘোচানোর যেন একটাই বিকল্প— এক জন বলিয়ে-কইয়ে নেতা। সরকারি নীতি বা তার প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে বেজায় পরিশ্রম। সেই তুলনামূলক আলোচনা করার মধ্য দিয়েই যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়, সেই ধারণাও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। যদিও এখন সব চেয়ে বড় সমস্যা কী ভাবে গণতন্ত্রকে শাসনব্যবস্থার উপযোগী করে ধারণ করা সম্ভব। গণতন্ত্র সর্বদাই বিভিন্ন মতামত তুলে ধরবে। তা শাসকের মতামতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে পরম আদরণীয়, আর না হলেই ‘আরবান নকশাল’— এই চরমপন্থী অবস্থান আসলে গণতন্ত্রকে বুঝতেই অস্বীকার করে।

Advertisement

ক’দিন আগেও যা ছিল অ্যান্টি-ন্যাশনাল, তাই এখন ‘আরবান নকশাল’। জাতীয়তাবাদ বিষয়টি এখন আর বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। যাঁদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী ওই সুখস্বপ্ন রচনার চেষ্টা হয়েছে, তাঁরা, অর্থাৎ হিন্দুরাই, এখন দ্বিধাবিভক্ত। দলিত হিন্দু বুঝতেই পারছেন না কী ভাবে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’কে প্রতিহত করে বৃহত্তর হিন্দু জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা সম্ভব। এই মৌলিক প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন তাঁরাই সরকারি বিচারে ‘আরবান নকশাল’ আর রাজনীতির বিচারে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’।

এইখানেই অ-রাজনীতির সমস্যা। ব্যক্তি মোদীকে পূজা বা আক্রমণের মধ্যেও সেই একই সমস্যা। অর্থাৎ, রাহুল গাঁধী কতটা পরিণত হলেন, সেই নিয়ে আলোচনাও গণতন্ত্রের মূল শর্তকে লঙ্ঘন করে। ‘কে বলছেন’, সেই প্রশ্নটা প্রাক-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্ব পেলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিন্তু ‘কী বলেছেন’ সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যর্থতার ফলে জাতীয়তাবাদীরা বোঝাতে সক্ষম হন যে তাঁদের বিচারধারাই প্রধান, অথচ গণতান্ত্রিক আবহই যে জাতীয়তাবাদের জন্মদাতা, এই বিচার তখন সম্পূর্ণ ভাবে বিস্মৃত হতে হয়। জাতীয়তাবাদী ভাবনা একটি সামগ্রিক বিষয়, যার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে নীতি আলোচনাহীন ব্যক্তিগত মর্জির যে রাজনীতি, তার একটি অন্তর্বিরোধ আছে।

অথচ জাতীয়তাবাদী চিন্তা অতিক্রম করতে পারে যে রাজনীতি, তা এই মুহূর্তে অনুপস্থিত। প্রতিরোধ প্রতিবাদ সব চলুক, কিন্তু বিকল্প নীতিগুলিকেও তো চিহ্নিত করতে হবে। এইখানেই মতাদর্শের প্রশ্ন উপস্থিত হয়। ক্ষমতার চিন্তা যখন ব্যক্তিগত নেতৃত্বের মুখোশ পরে ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রতিস্পর্ধী মতাদর্শ বা জীবনভাবনা কোথায়? তাই ভিন্ন মতাদর্শবাহী রাজনীতিকেই সেই দায় নিতে হবে।

এখানেই সমস্যা। বামপন্থী মতাদর্শের একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনবোধ রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের প্রশ্নে ওই গণতান্ত্রিক শর্তকে লঙ্ঘন করার ফলে তা পূর্ণ বিকশিত হতে পারল না। বিশ্বের কোথাও প্রকৃত অর্থে মার্ক্সীয় প্রজ্ঞার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। গণতান্ত্রিক চিন্তাই যে মতাদর্শের জন্মদাতা, সেই মৌলিক বোধের অভাবই এর জন্য দায়ী। মুক্ত চিন্তার চাহিদাই তো মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং সেই মুক্ত চিন্তাকে শ্রেণি বা জাতির দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণের অর্থ হল সেই গাছের ডালটাই কেটে ফেলা, যা এত দিন নিশ্চিন্তে বসার ভরসা জুগিয়ে এসেছে।

তবে, বামপন্থী চেতনার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। সাবেকি মার্ক্সীয় প্রয়োগ বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ায় একটি নতুন জীবনবোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা সমগ্র বিশ্বের বামপন্থী মহলেই লক্ষ করা যাচ্ছে। শুধুমাত্র শ্রেণির বিমূর্তায়িত অবয়ব নয়, মানুষের অনেকান্ত চাহিদাগুলি প্রতিষ্ঠিত করার ঝোঁক রয়েছে এই নয়া বামপন্থায়। বস্তুত এখানেই তো কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিকদের সঙ্গে মার্ক্সীয় প্রজ্ঞার বিরোধ। পুঁজিবাদকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান যে করা যায় না তা তো মার্ক্সই শিখিয়েছেন। একই রকম ভাবে পার্টির ভাবনার মধ্যেও যে রুশ বিপ্লববাহী কালের প্রেক্ষিতে অবরুদ্ধ কাঠামো রয়েছে, তারও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন প্রয়োজন। একেবারে গ্লাসনস্ত নয়, কিন্তু ভিন্ন আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। বামপন্থীরা পার্টির অন্তর্বর্তী গণতন্ত্র নিয়ে ভাবেন প্রচুর, কিন্তু এখন বিশ্ব জুড়ে নয়া বামপন্থার যে ঢেউ উঠছে তা ক্রমাগত ভাবে পরিবর্তনশীল বাস্তবতার সাপেক্ষে মতাদর্শের উপাদানগুলিতে নাড়াচাড়া লাগিয়েছে। বর্জনের থেকে গ্রহণ এখন অধিকতর তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশেও এমন সুযোগ আছে। না হয় তা নির্বাচনকেন্দ্রিকই হল। দক্ষিণপন্থা যখন নেতৃত্বের প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য অ-রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তখন তার প্রতিরোধে রাজনীতিতেই আশ্রয় নিতে হবে। তার একমাত্র উপায় হল বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামতকে নির্দিষ্ট বিকল্প নীতি হিসেবে উপস্থাপন করা। জোট সরকারের দিকে যদি এগোতেই হয়, সর্বাগ্রে প্রয়োজন জোট রাজনীতি। আজকের মতাদর্শ এই অনেকান্ত বোধকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠতে পারে।

১৯৭৭ সালের জোট নেতৃত্বের প্রশ্নে ভেঙে গিয়েছিল। যদি নীতির প্রশ্নে সে দিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারত, তা হলে আমাদের দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটি চমৎকার বিকাশের সম্ভাবনা ছিল। সেই জোটে গাঁধীবাদীদের সঙ্গে ছিলেন হিন্দুত্ববাদীরাও। কিন্তু তাঁরা পারস্পরিক সহাবস্থানকেই মেনে নিতে পারলেন না। ভি পি সিংহের সরকারও এই সমস্যা কাটাতে জেরবার হয়ে গিয়েছিল। অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু পেরেছিলেন কতগুলো স্থির বিকল্প নীতি প্রণয়ন করতে। সেগুলির প্রয়োগ সুদূরপ্রসারী হয়েছে। কিন্তু সঙ্ঘকে সামলানো অসম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে।

মনমোহন সিংহ পেরেছিলেন একটি যথার্থ রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দিতে। দু’টি ইউপিএ ভিন্ন জোটসঙ্গী নিয়েও খারাপ চলেনি। এর কারণ মনমোহনের ব্যক্তিত্বের ভার অত ছিল না। সর্বদাই সরকারের কোনটা করা উচিত আর কোনটা নয়, এই নিয়ে বিতর্ক চলেছে। জোটসঙ্গী পরিত্যাগও করেছেন নীতির প্রশ্নেই। তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া হয়তো সর্বদা সম্ভব নয়, কিন্তু রাজনীতির ওই পদ্ধতিটি অনুকরণযোগ্য। কোনও বিষয়ে একমত না হয়ে যদি কিছু সময় চুপ করে থাকা যায় তবে তাকে ‘নীতিপঙ্গুত্ব’ বলে না। আর নোটবন্দির মতো আচমকা ঘোষণা করে-দেওয়া নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকেও নীতি-বিকল্প বলা যায় না।

অতএব যদি জোটই হয়, তবে তার ভিত্তি হোক বিকল্প নীতি। মানুষের কাছে বলা হোক, কী ভাবে তাঁরা নতুন সরকারের দ্বারা উপকৃত হতে পারেন। কী ভাবেই বা এই দেশটিকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয় আবার নিজের দেশ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, যাতে নিহিত থাকবে এই প্রতীতি, ‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন