প্রতিবাদ, আন্দোলন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়

আন্দোলন জোট বাঁধার পাশাপাশি সুখ, দুঃখ ভাগ করে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। আমার ভাল অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত— এই চেতনার জাগরণে মনুষ্যত্বের উত্তরণ ঘটে। লিখছেন শালিনী ভট্টাচার্যআন্দোলন জোট বাঁধার পাশাপাশি সুখ, দুঃখ ভাগ করে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। আমার ভাল অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত— এই চেতনার জাগরণে মনুষ্যত্বের উত্তরণ ঘটে। লিখছেন শালিনী ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৯ ০১:১৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

মানুষের ইতিহাস বিদ্রোহ, বিপ্লবের ইতিহাস। সম্মিলিত গণ আন্দোলনের ইতিহাস। পরাধীন ভারতবর্ষ অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো বহু ছোট, বড় আন্দোলন দেখেছে। তার পরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য মানুষ বার বার আন্দোলন করেছে। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চেয়ে

Advertisement

আন্দোলন করেছে।

আন্দোলনের সবথেকে ইতিবাচক দিক হল, যে কোনও আন্দোলন জোট বাঁধতে শেখায়। একসঙ্গে সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিতে শেখায়। সবার সঙ্গে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। আমার ভাল অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত— এই চেতনার জাগরণে মনুষ্যত্বের উত্তরণ ঘটে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে এখন আমরা বহু জোটবদ্ধ আন্দোলন, অনশন দেখছি। কখনও চাকরি প্রার্থীরা ধর্না দিচ্ছেন, কখনও ডাক্তারেরা কর্মবিরতি করছেন, গণ-ইস্তফা দিচ্ছেন । কখনও উকিলদের কর্মবিরতিতে দীর্ঘ দিন আদালত অচল থাকছে। পেশাদার মানুষেরা একসঙ্গে প্রতিবাদ করলে কর্মের গতি ব্যাহত হয়। সাধারণ মানুষেরও বহু অসুবিধা হয় ঠিকই। কিন্তু আন্দোলন একতার বার্তা দেয়।

যারা নিয়মিত অন্যায় করে চলেছে, যারা অবিচারকে নিয়মে পরিণত করেছে তাদের থমকে দেয় আন্দোলন। সাধারণ মানুষের মনের ভয় কাটায় আন্দোলন। তাদের ভরসা জোগায় আন্দোলন। ‘ওরা প্রতিবাদ করলে আমরা পারব না কেন?’— এই বোধ জাগিয়ে দেয় আন্দোলন। তাই আন্দোলন, প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি। সব আন্দোলন সেই কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন আসলে শিরদাঁড়া সোজা করে বেঁচে থাকার মাধ্যম।

সমসাময়িক পৃথিবী বড্ড আত্মকেন্দ্রিক। ‘আমি আর আমার পরিবার’— এর বাইরে ভাবতে ভুলে যাচ্ছে মানুষ। খুব বেশিদিনের কথা নয়। কাগজ ছেয়ে গিয়েছিল এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের অনশনের ছবিতে। দুধের শিশুকে নিয়ে এক মা-ও ছিলেন সেই অনশন মঞ্চে। এক হবু মা অনশন করার সময় তাঁর সন্তান গর্ভেই মারা যায়। সেখানে বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেলিব্রিটি, শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা গিয়েছেন। একক উদ্যোগে ইতস্তত শিক্ষক, অধ্যাপকেরা উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের উপস্থিতি সেখানে নগণ্য ছিল।

কলকাতার সাধারণ মানুষ পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে আন্তরিক ভাবে তাঁদের সঙ্গে দু’টো কথা বলতে পারতেন। পাশে থাকার বার্তা দিতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অথচ এই ছেলেমেয়েরা আমাদের বড় চেনা। তাঁদের মুখ ও আমাদের সন্তানের মুখ একাকার হয়ে যায়। এখনও মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা চান, তাঁদের সন্তানেরা সরকারি চাকরি করুক। নিম্নবিত্ত অভিভাবকেরাও পরিবারের মেধাবী ছেলে-মেয়ের জন্য শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখেন। তবুও তাঁরা আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াতে চাননি। একই ঘটনা এখন ঘটছে এই রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গেও। কলকাতার রাস্তায় তাঁদের অনশন চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। কলকাতার নাগরিক সমাজ নিরুত্তাপ। অথচ এর বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সময়। এই আন্দোলনে সবথেকে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন সেই অসহায় রোগী ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। যাঁরা প্রাণ বাঁচান তাঁদের আক্রমণ করা যে ঠিক নয় সে কথা সাধারণ রোগীরা বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন। এতটা সমর্থন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাননি। তার একটা কারণ এটা হতে পারে যে, তাঁরা কর্মবিরতির পথে যাননি। এ রাজ্যের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে। পরিষেবা মিলছে বলেই হয়তো মানুষ এখনও শিক্ষকদের অনশনের ব্যাপারে উদাসীন।

সমাজের এই নিস্পৃহ রূপ ক্রমশ সামাজিক ব্যাধির আকার নিচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলন যা গোটা দেশকে আলোড়িত করেছিল, তেমন ঘটনা সাম্প্রতিক কালে বিশেষ ঘটেনি। এখানেই পেশাগত দাবি আদায়ের আন্দোলনের গুরুত্ব। হোক না কেবল ভুক্তভোগীদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আন্দোলন, হোক না কেন ক্ষণস্থায়ী তবুও তা মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অন্যায় সয়ে যাওয়ায় শুধু একমাত্র পথ নয়। অন্যায়ের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করেও যে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা যায় তা মানুষকে বার বার মনে করিয়ে দেয় আন্দোলন। অনেক মানুষ সরাসরি না হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনকে সমর্থন করেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক টুইটারে মানুষ অন্যের সমস্যার কথা জানছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, বহু বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দিচ্ছেন। এর গুরুত্বও অসীম।

সাম্প্রতিক সময়ের সবথেকে বড় অসুখ নির্লিপ্ততা, আত্মকেন্দ্রিকতা। অর্থাৎ, অপরের সমস্যা থেকে নিজেকে সুকৌশলে সরিয়ে রাখা। এই ভাবনা আঘাত পায় যখন একটা ফেসবুক পোস্ট দেখে বিচলিত হয়ে কেউ কোনও মন্তব্য করে ফেলেন। সেই মুহূর্তে মানুষটি নির্লিপ্ততার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। মানসিক যে কোটরে তাঁর বাস, তার দরজা খুলে যায়। বাইরের আলো, বাতাস প্রবেশ করে। হয়তো ক্ষণিকের জন্য। তবুও তা জরুরি। কারণ, সমাজের ভাল-মন্দের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের ভাল-মন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেশিরভাগ মানুষ ভাল না থাকলে কোনও ব্যক্তি মানুষও ভাল থাকতে পারে না। দুর্নীতিযুক্ত, বৈষম্যপূর্ণ, ভারসাম্যহীন সমাজের সকল নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। সে প্রত্যক্ষ ভাবে হোক বা পরোক্ষ ভাবে। মানুষ ভাল নেই, আমরা ভাল নেই— এই বার্তা জনমানসকে ধাক্কা দেয়। আর তাই দুর্নীতির কথা, অবিচারের কাহিনি সকলের গোচরে নিয়ে আসে প্রতিবাদ, আন্দোলন। তাই আন্দোলন চলুক। চলুক প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশ।

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ মানুষ ভুলে গেলে সমাজে অন্যায়কারীরা দাপিয়ে বেড়াবে। আজ শিক্ষকেরা আক্রান্ত, কাল আমরাও আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারি— এই সচেতনতা জরুরি। একটি সফল আন্দোলন যা কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক অন্যায়ের প্রতিকার করতে পেরেছে তা আরও অনেক আন্দোলনের পথিকৃৎ

হয়ে থাকে।

আদিম মানুষ জোট বেঁধেছিল নিজেদের স্বার্থে। আমাদেরও নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালর জন্য বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বাঁচতে হবে। সমাজকে কলুষমুক্ত করতে হলে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতেই হবে। তাই মানুষ একে অন্যকে আরও জড়িয়ে থাকুক। সমাজ হোক অন্যায়মুক্ত।

প্রধান শিক্ষিকা, ডোমকল বালিকা বিদ্যাপীঠ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন