ঠিকানা ‘বটগাছের নীচে, মন্দিরের পাশে’, আধার মিলবে?

সংলাপের এমনই ধরন আজকাল। ‘কোথায় আছো?’ যে জানতে চায়, কোন বাড়িতে কুরিয়ার আপনার পার্সেল ডেলিভারি করে, তাতে তার কিছু যায়-আসে না।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

আপনার ছেলে যেন কোথায় আছে? ও তো টিসিএস-এ ছিল। এখন আইবিএম। আপনার মেয়ে? সে জেএনইউতেই আছে, কিন্তু জামাই এখন আছে টিআইএফআর-এ।

Advertisement

সংলাপের এমনই ধরন আজকাল। ‘কোথায় আছো?’ যে জানতে চায়, কোন বাড়িতে কুরিয়ার আপনার পার্সেল ডেলিভারি করে, তাতে তার কিছু যায়-আসে না। ‘আপনার পাড়াই আপনার পরিচয়’ — সে দিন আর নেই। হয়তো একাত্তর বাই তিয়াত্তর কেনারাম দত্ত লেন, ঠিকানা দেখে নাক কুঁচকোলেন। গিয়ে দেখলেন, ‘হুইসলিং উডস’ কিংবা ‘কাসা এস্পানিয়া’ গোছের নাম-আঁটা রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স। আট হাজার টাকা স্কোয়্যার ফুট, মেনটেনান্স মাসে এগারো হাজার। ব্যস, হিসেব বানচাল। ‘তুমি কোথাকার দত্ত হে, ওয়েলিংটন নাকি রামবাগান,’ এ সব প্রশ্ন চলত যখন পাড়া-প্রতিবেশী দেখিয়ে বিয়ে ঠিক করত ঘটক। ‘আরে মশাই, ছেলের বাড়ি আর সিটি কলেজের প্রফেসরের বাড়ি, কমন পাঁচিল। আর উল্টো দিকে তিনতলা বাড়িটা? ব্রজেন বক্সী, অ্যাডভোকেট।’ শুনে কনের বাপ ভরসা পেতেন।

এখন সার্চ চলে ইন্টারনেটে। পাত্রী রিসার্চ করছে বেঙ্গালুরুতে, পাত্র চাকরি করছে পুনেতে, দু’জনেই ‘সেট্ল’ করতে চায় সিডনি কিংবা সিয়াটলে। কনের মা আবু ধাবিতে ইন্টিরিয়ার ডিজাইনার, বাপ হয়তো দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে গুয়াহাটিতে। বরের বাবা মার্চেন্ট নেভির জাহাজে, ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুড দিয়ে ঠিকানা লেখেন। বরের মায়ের বাপের বাড়ি লখনউ, শ্বশুরবাড়ি তিরুঅনন্তপুরম, দিল্লির অফিস থেকে রিটায়ার করে বৃদ্ধাশ্রম চালাচ্ছেন দেরাদুনে। এ বার বলুন, কোথায় গিয়ে পরিচয় খুঁজবেন বর-কনের?

Advertisement

একবিংশের নাগরিকের পরিচয় যদি বাড়ির ঠিকানায় না-ই মেলে, যদি ‘ঠিকানা’ জিনিসটাই বেপাত্তা হয়ে যায়, তবে ‘পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস’ না দিলে আধার কার্ড দেবে না কেন সরকার? জন্মে থাকলে জন্মের তারিখ থাকবেই, মা-বাপও থাকতে পারে (না-ও পারে। সিঙ্গল পেরেন্ট, বা দু’জন এক জেন্ডারের পেরেন্ট হলে ক্ষতি কী?) কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা থাকতে হবে কেন? বাপ-দাদার যে গ্রামের ভিটে চোখেও দেখিনি, বিয়ের পর দু’চার দিন ছাড়া যে শ্বশুরবাড়িতে থাকিনি, কিংবা চার বছর আগে কেনা যে ফ্ল্যাট তালাবন্ধ পড়েই আছে ভিন্শহরে, স্রেফ ‘ইনভেস্টমেন্ট পারপাসে’, তাকে আমার স্থায়ী ঠিকানা মনেই হয় না। অথচ সরকারি ফর্ম ভর্তি করতে সেটাই লিখতে হচ্ছে। এ যেন মিথ্যে বলার নেমন্তন্ন।

ঠিকানা জিনিসটাই বা ক’টা লোকের আছে? সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছে, যাঁর বাড়ি নেই, তাঁর কি আধার কার্ড হবে না? তিনি হয়তো উদ্বাস্তু, নদীর পাড় ভেঙে তলিয়ে গিয়েছে জমি-বাড়ি। কিংবা কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে এসেছিলেন শহরে, কুড়ি বছর ধরে ফুটপাতই তাঁর আস্তানা। হয়তো পূর্বপুরুষ বাস করেছেন যে অরণ্যে, সেখানে তাঁর এখন প্রবেশ নিষিদ্ধ। জনগণনা বলছে, ভারতের শহরে বেড়ে চলেছে। আধার কার্ড না থাকার জন্য এঁরা যদি ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে না পারেন, দিনমজুরির টাকা না জমা করতে পারেন ব্যাঙ্কে, সে তো হবে অন্যায়ের উপর অন্যায়। স্থায়ী ঠিকানা নেই বলে সতেরো কোটি লোক তো ‘নেই’ হয়ে যায়নি।

নরেন্দ্র মোদী মস্ত ছাতি ঠুকে বলতে পারেন, কুছ পরোয়া নেহি, ঘর বানিয়ে দেব। ২০২২ সালের মধ্যে সব্বাইকে ঘর দেব।

দিলেই সবাই নেবে কেন? রাজস্থানের এক শিক্ষিকা গল্প করেছিলেন, আবু পাহাড় এলাকার জঙ্গলবাসী জনজাতির শিশুদের শিক্ষাশিবির হয়েছিল গ্রামের ইস্কুলে। অ-আ শিখতে তাদের অত আপত্তি ছিল না, কিন্তু রাতেই গোল বাধল। উপরে আকাশ নেই, গাছ নেই, ছাদ-দেওয়ালের মধ্যে শোওয়া? এক লাফে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাত তারা, হাসছিলেন সেই দিদিমণি। ভারতে একশোয় একজন যাযাবর। ছাগল-গরু-ইয়াক পালন করেন, নাচ-গান, খেলা দেখান। একখানা কার্ডের জন্য তাঁরা এখন মাথাপিছু আড়াই কাঠা খুঁজে ফিরবেন? কোন থানা, কোন পোস্টাপিস, কত নম্বর ল্যাম্প পোস্ট, জানলে থানার ওসি-র সুবিধে হয় ঠিকই। কিন্তু পুলিশের জন্য নাগরিক তো আর নয়, নাগরিকের জন্য পুলিশ। যে পুলিশ নিজে ঘনঘন বদলি হয়ে যায়, যে বিডিও কালই চলে যাবে অন্য জেলায়, সে যদি আহির কিংবা গুজ্জরের পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস দাবি করে, তারা মুচকি হাসবেই। কে কার দলে ভেবে দেখবেন স্যার। রিটায়ার করে গ্রামের বাড়িতে ফিরবেন তো?

স্থায়ী ঠিকানা হয় না সন্ন্যাসী, ফকিরদের। মরে যাওয়ার পর বাবার থান, দরগা-মাজার হতে পারে। বেঁচে থাকতে রমতা সাধু, বহতা পানি। সত্যি, আজকের যুগ হলে গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে কী গোলটাই না বাধত। কাল রাজগিরের জঙ্গলে, তো পরশু বৈশালীর বাগানে। জন্ম গাছতলায়, মৃত্যুও গাছতলায়। পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস-এর জায়গায় ‘কিংস প্যালেস, কপিলাবস্তু’ লিখতে চাইলেও আপত্তি। বোঝো ঠ্যালা। পেট চালাও তবে আম্রপালীর বাগানের আম কুড়িয়ে। শূকরমদ্দভ খেয়ে শয্যা নাও। রেশনের দু’টাকা কিলো চাল আর পেতে হচ্ছে না। মোবাইল কানেকশন জুটবে না, সংঘের শ্রমণদের রান্নার জন্য গ্যাসও মিলবে না। এ তো বিম্বিসার কি অশোকের ভারত নয়, যে রাজা পায়ের ধুলো নিয়ে হাত উপুড় করবে। এ হল নরেন্দ্র মোদীর ভারত। সন্ন্যাসী কর্পোরেট কোম্পানি চালিয়ে ট্যাক্স-ডিসকাউন্ট চাইতে পারে, কিন্তু ‘আন্ডার বটগাছ, নেক্সট টু কালীমন্দির’ ঠিকানা দেখিয়ে আধারের আবেদন করতে পারে না। রাস্তার উপর একটা মাটির জালায় থাকতেন বলে ডায়োজিনিসকে যদি গ্রিস ‘সিটিজেন’ না বলত, তেঁতুলতলায় থাকতেন বলে বুনো রামনাথ ডিসকোয়ালি হয়ে যেতেন ভোটার কার্ড থেকে, ক্ষতিটা হত কার?

তা ছাড়া সাচ্চা দেশপ্রেমীর ঠিকানা বোঝা অত সহজ নয়। কাগজের অফিসের কাছাকাছি এক পানশালা থেকে মাঝরাতে বেরিয়ে দুই সহকর্মী দেখেন, সেখানকারই এক রেগুলার পিনেওয়ালা ফুটপাতে ফ্ল্যাট। তাঁদের কর্তব্যবোধ জেগে উঠল, ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে বার বার জানতে চাইলেন, ‘ঠিকানা কী? কোথায় থাকেন?’ বহু চেষ্টার পর উত্তর এল, ‘হিন্দুস্তান।’

‘পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস’-এর ঠ্যালা সামলাচ্ছে লেবার মার্কেটও। প্রোবেশন টু রিটায়ারমেন্ট একই আপিসে, সে দিন আর নেই। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় পুঁজি সরে সরে যাচ্ছে, কাজও সরছে ক্রমাগত। যার ‘নিজগৃহ’ বস্তুটির পিছুটান নেই, সে দিব্যি কাজের পিছু পিছু যায়। আর বাড়ি কিনে এক কাঁড়ি ঋণ নিয়ে যে বসে আছে, সে কম টাকা পেলেও থেকে যেতে চায়। এমনকী চাকরি খুইয়েও শহর ছাড়তে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপে দেখা যাচ্ছে, বাড়ির মালিকানা যেখানে বেড়েছে, সেখানে বেকারত্বও বেড়েছে। কাজের বাজার চাঙ্গা করতে হলে বরং বাড়ির ভাড়া কম রাখতে হবে, ভাড়ার দেওয়ার মতো বাড়ি থাকা চাই বেশি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

আর সংসারে? সেখানেও সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে বাড়ি। ‘বেঁচে থাকতে বাড়ি বিক্রি হতে দেব না,’ আজও বাপ-মায়ের বাঁধা সংলাপ। এ দিকে সন্তান চায় টাকা, অচল পুঁজিকে সচল করে জীবনে দ্রুত উন্নতি। অতএব মন কষাকষি। নবীনদের প্রস্থান, বাড়িতে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ। হয়তো একটা দিন আসবে, যেদিন মার্কিনিদের মতো বাঙালি বুড়োবুড়িও বাড়ি বেচে একটা ‘মোবাইল হোম’ কিনবে। চাকার উপর ড্রয়িং-ডাইনিং, বেডরুম-বাথরুম। তাই নিয়ে এ রাতে পার্কিং করবে মায়াপুর, ও রাতে লালবাগ। চরৈবেতি, চরৈবেতি। মানুষই দু’দিনের, তার আবার চিরকালের ঠিকানা কী? উঠবে নতুন দাবি, আধার কার্ডের ফর্মে স্থায়ী ঠিকানার খোপে গাড়ির নম্বর লিখতে দিতে হবে।

শিকড়ের খোঁজও পড়ে, তবে তা শেষকৃত্যে। দুই-তিন প্রজন্ম যাঁর বাস কলকাতায়, গয়ায় গিয়ে পান্ডাকে তিনি পরিচয় দেন, ‘ঢাকা বিক্রমপুর, সাকিন অমুক।’ যাদবপুর কি পাইকপাড়ার ফ্ল্যাটবাড়ির ‘স্থায়ী ঠিকানা’ মেলে ময়মনসিংহ, মেদিনীপুর, মুঙ্গেরে। সে-ও সত্য, কিন্তু তাকে তো আর ‘তথ্য’ বলা চলে না। জীবনের সীমা অতিক্রম করে বয়ে চলা এই পরিচয়। হাত পেতে প্রসাদ পাওয়ার মতো জীবনকে পেয়েছি আমি, দিয়ে যাব আর কারও হাতে। পূর্বপ্রজন্ম আর পরপ্রজন্মের মধ্যে ব্যক্তির দৈব-নির্দিষ্ট এই যে অবস্থান, কালের প্রবাহে কেবল এটুকুই অপরিবর্তনীয়। স্থায়ী ঠিকানা যদি কিছু থাকে মানুষের, তবে তা এই।

এ কি লেখা যায় সরকারি ফর্মে? যায় না। আচ্ছা, ঠিকানার জায়গায় মোবাইল নম্বরটা দিলে হয় না? বদলে গেলে জানিয়ে দেব, প্রমিস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন