সম্পাদকীয় ১

ডুবিছে মানুষ

সোমনাথ মন্দিরের খাতায় রাহুল গাঁধীর নামটি তাঁহার সহকর্মীরা ভুলক্রমে নথিভুক্ত করাইয়াছিলেন, না প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করিয়া তাহা লিখাইয়াছেন, সেই রহস্য সন্ধানের কাজ গোয়েন্দাদের জন্য বরাদ্দ থাকুক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১১
Share:

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে উন্নয়ন-গর্বিত ভারতের ততোধিক উন্নয়ন-গর্বিত রাজ্য গুজরাতের নির্বাচনী রণভূমি হইতে প্রশ্ন উঠিয়া আসিল: রাহুল গাঁধী কি হিন্দু? যেন এই প্রশ্নটি গুজরাত তথা ভারতের উন্নয়নের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেন এই প্রশ্নের মীমাংসার উপর নির্ভর করিতেছে, ২০২২ সালে ভারতের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার কত হইবে। যেন এই প্রশ্নের উত্তর না পাইলে ক্রেডিং রেটিং বাড়াইবার সাধনা ব্যাহত হইবে। স্বাধীনতার সাত দশক পরে গণতান্ত্রিক ভারত কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, এই প্রশ্নটি তাহার পরিচায়ক। সেই পরিচয় গৌরবের নহে, কলঙ্কের। যাঁহারা প্রশ্নটি তুলিয়াছেন, সেই কলঙ্কের প্রধান দায় তাঁহাদের। কিন্তু যাঁহারা ভোটের মুখ চাহিয়া এই প্রশ্নের উত্তরে তারস্বরে রাহুল গাঁধীর হিন্দুত্ব প্রমাণ করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, দায়ভাগ তাঁহারাও অস্বীকার করিতে পারিবেন না।

Advertisement

সোমনাথ মন্দিরের খাতায় রাহুল গাঁধীর নামটি তাঁহার সহকর্মীরা ভুলক্রমে নথিভুক্ত করাইয়াছিলেন, না প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করিয়া তাহা লিখাইয়াছেন, সেই রহস্য সন্ধানের কাজ গোয়েন্দাদের জন্য বরাদ্দ থাকুক। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির নায়কনায়িকারা যে ভাবে এই নথিভুক্তির ‘গূঢ় অর্থ’ উদ্ধার করিয়া কংগ্রেস সহ-সভাপতির ধর্মপরিচয় লইয়া কুরুক্ষেত্র করিতেছেন তাহা বুঝাইয়া দেয়, ভোটে জিতিবার জন্য তাঁহারা সম্পূর্ণ মরিয়া। নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বিকাশপুরুষ হিসাবে জনসমক্ষে বিপণনের চেষ্টা চালাইয়া আসিতেছেন, তাহার জন্য বিস্তর ঢাকঢোল পিটাইয়াছেন, রাতারাতি নোট বাতিল করিয়া অসহায় নাগরিকদের বিস্তর যন্ত্রণা দিয়াছেন, ইভাঙ্কা ট্রাম্পের শংসাপত্রও আদায় করিয়াছেন, কিন্তু সুযোগ পাইলেই— অথবা সুযোগ তৈয়ারি করিয়া— তাঁহার দল ‘গুজরাত মডেল’ ছাড়িয়া ‘সোমনাথ মডেল’ আঁকড়াইয়া ধরিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে নাই। এবং তিনি নিজেও কোনও দিনই দলের বাহিরে ছিলেন না, আজও নহেন— নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়াইয়া প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নামে গাল পাড়িয়া বলিয়াছেন, তিনি সোমনাথ মন্দির নির্মাণের বিরুদ্ধে ছিলেন! নেহরু যে উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানগুলিকে নূতন ভারতের মন্দির বলিয়া বরণ করিয়াছিলেন, সে কথা মোদী ও তাঁহার ভক্তদের বলিয়া লাভ নাই, তাঁহারা ও-রসে বঞ্চিত।

কিন্তু কংগ্রেস? বিজেপির আক্রমণের মুখে পড়িয়া তাহারা যে ভাবে রাহুল গাঁধীর হিন্দুত্ব প্রমাণে তৎপর হইয়া পড়িয়াছে, তাহাকে চমকপ্রদ বলিলে কম বলা হয়। ভোটের ফসল তুলিতে হিন্দুত্ববাদীদের এই কুৎসিত রাজনীতির তীব্র প্রতিবাদে মুখর হইয়া যাঁহাদের বলিবার কথা ছিল, ‘বাজে কথা ছাড়িয়া কাজের কথা বলিয়া লড়াই করুন’, তাঁহারা রাহুল গাঁধীর উপবীত-সমন্বিত চিত্র প্রদর্শন করাইয়া তাঁহাকে হিন্দু প্রমাণে ব্যস্ত! সংঘ পরিবারের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেসের ত্রস্ত দুর্বলতা বারংবার দেখা গিয়াছে। হিন্দুত্বের কারবারিদের দাপট যত বাড়িয়াছে, কংগ্রেস ততই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধ্বজাখানি গেরুয়া রঙে রাঙাইতে চাহিয়াছে— পাছে ‘হিন্দু ভোট’ বিমুখ হয়। এ বার গুজরাতে রাহুল গাঁধীর মন্দির হইতে মন্দিরান্তরে ভ্রমণের কাহিনিও তাহারই অনুসারী। ইহা রাজনীতির কৌশল হইতে পারে, কিন্তু কৌশল রাজনীতিকে গ্রাস করিলে চলে না। কখন কৌশল ছাড়িয়া সরাসরি রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে, তাহা জানিতে হয়। নির্বাচনে জিতিবার জন্য যখন কেহ প্রশ্ন তোলে, প্রতিপক্ষ হিন্দু কি না, তখন সেই প্রশ্নটিকেই আরব সাগরে নিক্ষেপ করিয়া ঘোষণা করিতে হয়: ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার। এইটুকু না পারিলে— ভোটের ফল যাহাই হউক— কান্ডারি হওয়া যায় না। নরেন্দ্র মোদী তাহা মানিবেন না, তাঁহার ধর্ম অন্য। কিন্তু রাহুল গাঁধী বুঝিবেন কি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন