১৯৩২ সাল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দেশ থেকে বেরোবার বয়স গেছে’। পারস্যরাজের নিমন্ত্রণ এল। কবি তা গ্রহণ করলেন। সেই তাঁর শেষ দেশের বাইরে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের সেই দেখার অভিজ্ঞতা লেখা আছে তাঁর ‘পারস্যে’ রচনায়। তিনি সেখানে নানা দেশে গড়ে ওঠা নেশন-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করছেন। নেশন নির্মাণের ফলে যে নানা সুবিধে হতে পারে আর তা যে নেশনের প্রকৃতির ওপরেই নির্ভর করে, সে কথা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনের এই প্রান্তবেলায় এসে পারস্যভ্রমণের অভিজ্ঞতার সূত্রে তিনি যেন তাঁর নেশন-সম্বন্ধীয় পূর্ববর্তী নানা অভিজ্ঞতা ও কথাকে আবার যাচাই করতে চাইছিলেন।
কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের আধুনিকীকরণ ঘটল। বিচারমন্ত্রী বললেন, আধুনিক নেশন ‘পৌরাণিক অন্ধসংস্কার’ দূর করবে। তুরস্কের মন্ত্রীর এই সভ্য নেশন নির্মাণের আশাদীপ্ত উক্তি ‘পারস্যে’ লেখাটিতে উদ্ধৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তাঁর যে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন সেটিই সূত্রাকারে উল্লেখ করলেন ‘পারস্যে’ রচনায়। ‘সোভিয়েট গবর্মেন্ট’ ‘ছোটো ছোটো জাতিকে আপন আপন রিপ্লাবিক স্থাপন করতে অধিকার’ দিয়েছে বলে রবীন্দ্রনাথ খুশি। জারের ‘সাম্রাজ্যিক শাসনে’ যে মারামারি কাটাকাটি ছিল তা আর নেই।
পারস্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেখানকার প্রধান রাজমন্ত্রীর। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘পারস্যের জনসংখ্যা এক কোটি বিশ লাখ, ভারতবর্ষের ত্রিশ কোটির উপর— এবং সেই ত্রিশ কোটি বহুভাগে বিভক্ত। পারস্যের সমস্যা অনেক বেশি সরল, কেননা আমরা জাতিতে ধর্মে ভাষায় এক।’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘দেশের প্রকাণ্ড আয়তনটাই তার প্রকাণ্ড শত্রু। চীন ভারতবর্ষ তার প্রমাণ। জাপান ছোটো বলে এত শীঘ্র বড়ো হয়েছে। স্বভাবতই ঐক্যবদ্ধ অন্য সভ্যদেশের রাষ্ট্রনীতি ভারতবর্ষে খাটবে না। এখানকার বিশেষ নীতি নানা দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে এখানেই উদ্ভাবিত হবে।’
লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ পারস্যের রাজমন্ত্রীকে সমাজ ও স্বদেশ নিয়ে একগাদা কথা বলতেই পারতেন। শোনাতেই পারতেন তাঁর শ্রীনিকেতনের কথা। শোনাননি। বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন। প্রথমত বাইরের কোনও রাষ্ট্রনৈতিক মডেল ভারতের ওপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র বিষয়ে, সমাজের উন্নতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশকালনিরপেক্ষ কোনও ছাঁচে বিশ্বাসী নন। নির্ধারণবাদীদের থেকে রবীন্দ্রনাথ এখানে আলাদা। দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সমাধান কোথায় তা রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ভাবে জানেন না। তবে আশা করেন নানা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এ দেশের মাটিতে তা কখনও ‘উদ্ভাবিত’ হবে। উদ্ভাবন একটা ক্রিয়া, তা থেমে থাকে না। আজ যে ব্যবস্থা কাজ করছে কাল তা কাজ না করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ লেখায় বলতে চেয়েছিলেন, দেশের ক্ষেত্রেও একই ধর্ম। প্রতি মুহূর্তে ব্যবস্থাটা যাচাই করা চাই। তিনি সিদ্ধান্তের অভিমুখ খোলা রাখছেন, ‘এটাই পরম সত্য’ বলে দ্বার রুদ্ধ করছেন না, দ্বাররুদ্ধ করলেই বিপদ। যে রাশিয়া দেখে রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত, সেই রাশিয়া তো পরে এমনি এমনি ভেঙে পড়েনি। সে বিপদের আভাসও ‘রাশিয়ার চিঠি’তে ছিল। (সঙ্গের ছবিতে রাশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ)
ভারতবর্ষ স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে নেশনবাদীরা বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করতে চাইলে আজ আমরা নিশ্চয়ই সব ফেলে রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত সমাজ ও স্বদেশ কেন হল না তার জন্য হাহাকার করে কাঁদতে বসব না। বরং বলব রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালে নেশনের যে কল্যাণকর দিকগুলি দেখতে চেয়েছিলেন, সেই কল্যাণের অভিমুখে আমাদের দেশকে যাতে চালিত করতে পারি সে জন্য সচেতন নাগরিকদের সরব হতে হবে। গণতন্ত্রের ধর্ম মেনেই। সচেতনতা ও সরবতা তো এমনি এমনি আসে না। রাশিয়ায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সমানে-সমানে কথা বলেছিলেন, ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। নেশনবাজদের প্রধান কায়দা হল তারা ‘ব্যক্তিবিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট’ করে দিয়ে কোনও একটা ছাঁচে সংখ্যাগরিষ্ঠকে ঢালাই করে সেটাকেই নেশন বলে চালাতে চায়। অনেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও ব্যক্তিসত্তাকে অস্পষ্ট করে একটা সুবিধেজনক ছাঁচকে চালাতে চেয়েছিল। সে ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।
নেশনের নামে যে বজ্জাতি দেশে দেশে দেখা যায়, তার উপসর্গগুলিকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে যাঁরা চিহ্নিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। আজ একুশ শতকের ভারতবর্ষে অ্যান্টিন্যাশনাল-এর ধুয়ো তুলে ভিন্নস্বরকে গুরুত্বহীন করতে চাইছে যারা, সেই নেশনবাজদের খারাপ নেশনের বিরোধিতা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ যে সামাজিক নীতিগুলি পালন করতে বলেছিলেন, ব্যক্তিগত বা ছোট পরিসরে সেগুলি পালন করতে পারি। আর নেশনবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, ভারতবর্ষীয় সমাজ ভিন্নরুচির অধিকারকে স্বীকার করেছে। এই দেশে অ্যান্টিন্যাশনাল-এর জিগির তুলে সবাইকে গলিয়ে এক ছাঁচে ঢালার চেষ্টা করলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবেই।
(শেষ)
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক