সম্পাদক সমীপেষু

দীর্ঘ ঈ ছাড়া মানায় না

পবিত্র সরকারের প্রবন্ধে (‘তবে তো শশীবাবুতেও...’, ২২-৪) হ্রস্ব ই- দীর্ঘ ঈ প্রসঙ্গে একটা পুরনো গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটা ভাষাচার্য সুনীতিকুমারকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের যেমন বানানে হ্রস্ব ই ব্যবহারের অভ্যেস ছিল, সুনীতিকুমারের ছিল এর উলটোটা।

Advertisement

বানানচিন্তা: রবীন্দ্রনাথ ও সুনীতিকুমার

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:১৩
Share:

পবিত্র সরকারের প্রবন্ধে (‘তবে তো শশীবাবুতেও...’, ২২-৪) হ্রস্ব ই- দীর্ঘ ঈ প্রসঙ্গে একটা পুরনো গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটা ভাষাচার্য সুনীতিকুমারকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের যেমন বানানে হ্রস্ব ই ব্যবহারের অভ্যেস ছিল, সুনীতিকুমারের ছিল এর উলটোটা। একটি, দুটি সুনীতিকুমারের লেখায় হয়ে যেত একটী, দুটী। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। কাজেই আর যেমন খুশি লেখা যাবে না। এ সময় এক দিন, সুনীতিকুমারের নজরে পড়ল, নিজের সদ্য প্রকাশিত বইতে ‘তরবারি’ বানান। উনি বইটির পরবর্তী সংস্করণের প্রুফ দেখার সময় ‘তরবারি’ কেটে করলেন ‘তরবারী’। কিন্তু ছাপা বইতে আবার যে কে সেই— ‘তরবারি’। সুনীতিকুমার প্রকাশককে তলব করলেন। প্রকাশক অভিধান খুলে দেখালেন, ‘তরবারি’ সংস্কৃত শব্দ, বানানটিও ও রকমই। সুনীতিকুমার হেসে বললেন, ‘দ্যাখো দেখি কাণ্ড! তবে, যা-ই বলো, তরবারির মতো জিনিস, দীর্ঘ ঈ না দিলে কী মানায়!’

Advertisement

সুদীপ জোয়ারদার

পাগলাচণ্ডী, নদিয়া

Advertisement

মাত্র এক টাকা!

১৫ মার্চ নামখানা ফিরছিলাম। স্টেশন থেকে নেমে নৌকাঘাটে যাওয়ার জন্য নারায়ণপুর সবজি মার্কেটের উপর দিয়ে যেতে হয়। দেখলাম, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের লড়াই। কারণ, ৩ মার্চ পর্যন্ত উচ্ছে এবং ঝিঙের দাম যথাক্রমে ২৫ টাকা এবং ২২ টাকা ছিল। ৪ থেকে ১৫ মার্চ অবধি সেই উচ্ছে এবং ঝিঙের দাম মাত্র ১ টাকা। ২৫ এবং ২২ টাকার ফসল রাতারাতি কমে ১ টাকা! বোঝাই যায় ব্যবসায়ীদের কারচুপি। সত্যিই, বাজারে সারের দাম বৃদ্ধি এবং উদয়াস্ত পরিশ্রমের ফল যদি ১ টাকা হয়, হাতাহাতিটা স্বাভাবিক।

শিবপ্রসাদ জানা

কলকাতা-১০৩

গ্রামই ভরসা

বাংলা বই ও বাংলা ভাষা ক্রমশ অধোগামী। আমরা পড়াশোনা করি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান এবং শিক্ষা তথা ডিগ্রি ভবিষ্যতে কতটা কার্যকর? ধীরে ধীরে মন্দার বাজারে কর্মক্ষেত্র কমছে। কাজের জন্য বাংলা ছেড়ে অ-বাংলাভাষী রাজ্যে যেতে হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আরও যেতে হবে। বাংলা ভাষার সঙ্গে থাকলে এ রকম কর্ম-প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়তে হয়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে যে যার মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি বা অন্য ভাষায় শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। যে বা যারা উচ্চ শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারল, তারা বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। যারা মোটামুটি শিক্ষা অর্জন করে, তারা সেখানেই জীবিকা-নির্বাহ শুরু করে দেয়। বাংলা ভাষা অঞ্চলে এই কর্মসংস্থান মস্ত ফ্যাক্টর।

এর পরবর্তী অবস্থান, বাংলায় চর্চা। কর্মক্ষেত্রে কোনও চিঠি পড়া বা লেখা কোনটাই বাংলায় নেই। সে সরকারি হোক বা বেসরকারি। সমস্ত প্রায় ওয়েবসাইট-নির্ভর। পুরোটাই ইংরেজি। অচেনা-অজানা বাংলা ভাষায় যে দু-একটা দরখাস্ত আসে, তা-ও বোধগম্যের বাইরে। এর বাইরে কয়েক জন শিক্ষক মহাশয়, সাহিত্যপ্রেমী এবং ছাত্রছাত্রী বাংলা বই নাড়াচাড়া করে। তা হলে বাংলা ভাষা কী ভাবে জগতে নিজস্ব স্থানে অটুট থাকবে?

সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়েরা, অর্থাৎ যাঁরা গল্প, উপন্যাস ও কবিতা লিখছেন, কতটা টানতে পারছেন পাঠক সমাজকে? বইমেলায় নামী প্রকাশক, সবে নামকরা বা অনামীদের কতটা স্থান দিচ্ছেন, তার মূল্যায়নে কিছুটা হলেও ভাষা অবস্থিত হয়। সেখানে সেই বঙ্কিম-শরৎ হয়ে সুনীল-শীর্ষেন্দু-সুচিত্রা-জীবনানন্দ-শঙ্খ-জয়-শ্রীজাততে থেমে গেছে। পরবর্তী তেমন আসছে না। কেন আসছে না? ভাবার বিষয়। অল্প ভাবনা, অল্প পাঠ, অল্প নিরীক্ষণ এবং অল্প বিষয়ীকরণ এই ভাষা হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়তো?

বাংলা ভাষায় যে গভীরতা রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত করে গেছেন, জীবনানন্দ প্রসারিত করে গেছেন তার আরও তলদেশে ডুব দিতে হবে। এবং লেখক হিসেবে, কবি হিসেবে সেই মুক্তো তুলে আনতে হবে। না হলে ভাষা হবে পঙ্গু।

বাংলা ভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে, চিৎকার করে কী লাভ? সেই বনলতা সেন, সেই চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, সেই শেষের কবিতা, সেই রক্তকরবী, সেই চাঁদের পাহাড়, সেই মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতে বাংলা সাহিত্য আটকে গেছে। আমি আমার ছেলেকে ধমকে বলতেই পারি, যা ও দিকে যা। সে আমাকে দেখিয়ে এগিয়ে যাবে, বাংলা বই কিনবে। কিন্তু যদি রসদ না পায়, খেলো কথায় তাকে ভোলানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলে সে রাস্তা বদল করবেই।

এ বার আসা যাক গ্রাম-বাংলার কথায়। যাদের ভরসায় বাংলা ভাষা এখনও জীবন্ত। খেটে-খাওয়া জীবনযাত্রায় বাংলা ভাষা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। গাথা, গান, পাঁচালি, যাত্রা, মঙ্গলকাব্য, গীতিকা, কীর্তন, লোকগান, ভাটিয়ালি এখনও নানা ভাবনা-চিন্তায় নিজের মতো প্রচারিত। সেই মাটির সঙ্গে বাংলা ভাষা শালুক ফুল তোলে, ডিঙি বায়, বৃষ্টিতে ভিজে চাষ করে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এই সব মানুষই বাংলা ভাষার পরম হৃদয়। এদের জন্যই কোনও দিন কোনও ভাবেই বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে না।

দীপঙ্কর বেরা

হাওড়া

বঙ্কিমী হিন্দু ধর্ম

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কোনও ধর্মকে ঈশ্বর-প্রণীত বা ঈশ্বর-প্রেরিত বলে মনে করতেন না। উগ্র, রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীদের যে ধর্মবোধ, তাকে তিনি জোরালো ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘হিন্দুধর্মে অনেক জঞ্জাল জন্মিয়াছে, ঝাঁটাইয়া পরিষ্কার করিতে হইবে।’ সোজাসাপটা বলেছেন, ‘‘হিন্দুধর্ম মানি, হিন্দুধর্মের ‘বখামি’গুলা মানি না।” হিন্দু ধর্মকে যে তিনি শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে ঘোষণা করেছিলেন, তারও আলাদা ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন। তাঁর বিবেচনায় মনুষ্যত্ব আর ধর্ম সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ধর্ম কী? বঙ্কিমী ভাষ্য হল, ‘যাহাতে মানুষের যথার্থ উন্নতি, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সর্ব্ববিধ উন্নতি হয়, তাহাই ধর্ম।’ এই উন্নতিকর তত্ত্বগুলোর উপস্থিতি হিন্দু ধর্মে প্রবল বলে তিনি মনে করতেন। হিন্দু ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ভেবেছেন সে কারণেই। ‘সব ব্যাদে আছে’-গোছের ধারণায় নয়, পূজা বা তন্ত্রের আচারিকতায় নয়, শাস্ত্র-বিরোধিতার মাধ্যমে তিনি ধর্মচিন্তার রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। স্পেন্সার, স্পিনোজা, কোঁত প্রমুখ দর্শনবিদের ভাবনায় পুষ্ট হয়েছিল হিন্দুধর্মের বঙ্কিমী ব্যাখ্যা। এ হল এক ধরনের ‘রিফর্মড হিন্দুইজম’, যা গেরুয়াবাদীদের হিন্দুত্ববাদকে নস্যাৎ করে নৈসর্গিক ধর্মের চেতনায় পৌঁছে দেয়। মানবপ্রকৃতিই যার ভিত্তি। হিন্দু ধর্ম নিয়ে দয়ানন্দ সরস্বতী, শশধর তর্ক চূড়ামণিদের ব্যাখ্যান তিনি মানেননি। মনুসংহিতা সম্বন্ধেও বিরূপ ছিলেন তিনি। ধর্মতত্ত্বের মধ্যে তিনি স্বজনপ্রীতি, দেশপ্রীতি খুঁজেছেন। পাশ্চাত্য ভাবের সাহায্যে গীতার নতুন ব্যাখ্যাকে তিনি হাজির করেছিলেন। কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন না করে কৃষ্ণচরিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনিই।

প্রশ্ন হল, শাস্ত্রবিরোধিতার সোপান বেয়ে ধর্মচিন্তার যে উন্মেষ সে দিন ঘটেছিল, হিন্দুত্ববাদের যে উদারমনস্ক চেতনা বঙ্কিমী ভাবাদর্শে সে দিন স্থান পেয়েছিল, তার কথা আমরা বিস্মৃত হলাম কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র, গীতাভাষ্য ইত্যাদি রচনার যত্নশীল পাঠ ছাড়াই তো আমরা তাঁকে সনাতনপন্থী, রক্ষণশীল, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী, কিংবা মুসলমান-বিদ্বেষী বলে ভেবে নিলাম। এ তো মস্ত ভুল। এর একটা কারণ এই যে, ঔপন্যাসিক বঙ্কিম এবং হিন্দু ধর্মের প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা বঙ্কিমের যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করে উঠতে পারিনি। তিনি তো আধুনিক মন নিয়ে দুটো কাজই করেছিলেন। হিন্দু ধর্মের মূল প্রত্যয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি যুক্তিবাদী ধর্মমত গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি রক্ষণশীল এবং অন্ধ হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। এ ভুল কি আজও সংশোধিত হয়েছে? মনে হয় না।

শিবাশিস দত্ত

কলকাতা-৮৪

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন