গুজরাত নির্বাচনের প্রচারপর্বে, এবং তাহার পূর্ববর্তী কয়েক মাসে, বিজেপির— বিশেষত নরেন্দ্র মোদীর— ব্যক্তি-আক্রমণভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক, রাজনীতির বিপ্রতীপে রাহুল গাঁধী যে রাজনৈতিক ‘রেটরিক’ বা প্রচারভাষা ব্যবহার করিতেছেন, ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তাহা পরিচিত নহে। কিছু কাল আগে এক জনসভায় ‘নরেন্দ্র মোদী মুর্দাবাদ’ স্লোগানে আপত্তি জানানো হইতেই সম্ভবত সেই নূতন রেটরিকের সূচনা। সেই সভায় রাহুল সমর্থকদের থামাইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, প্রবলতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরও মৃত্যু কামনা করা চলে না। গুজরাতের প্রচারপর্বে তিনি কঠোর আক্রমণ শানাইয়াছেন, কিন্তু তাহা কখনও ব্যক্তি-আক্রমণের স্তরে নামে নাই। নরেন্দ্র মোদী তাঁহাকে আওরঙ্গজেব বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়াছেন, তাঁহার ধর্মীয় পরিচয় লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছে বিজেপি— রাহুল সেই পাঁকে নামেন নাই। বরং জানাইয়াছেন, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিটির মর্যাদার কথা তিনি স্মরণে রাখেন। মণিশংকর আইয়ারকে বহিষ্কার করিয়া বার্তা দিয়াছেন, রাজনৈতিক মর্যাদার স্খলন তিনি সহ্য করিবেন না। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হইবার পর তিনি দলীয় কর্মীদের ‘হিংসার বিরুদ্ধে শান্তির রাজনীতি’র পথে অবিচল থাকিবার জন্য অভিনন্দন জানাইয়াছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রত্যয়ী সংযম এখন এমনই বিরল যে, গোটা দেশ তাহা নজর করিয়াছে। অনেকেই বলিয়াছেন, রাহুল গাঁধীগিরি করিতেছেন, আক্রমণের জবাবে ফুল ফিরাইয়া দিতেছেন। রাহুলের রাজনীতির যথার্থ বর্ণনা করিতে পারিত একটি অপরিচিত শব্দ: ‘নেহরুগিরি’।
গাঁধী ও নেহরুর রাজনীতির মধ্যে যদি ফারাক করিতে হয়, তাহা এই রকম— গাঁধীর রাজনীতি মূলত মরালিটি বা নৈতিকতার দ্বারা চালিত; নেহরুর রাজনীতি আইডিয়লজিকাল, বা আদর্শবাদী। আদর্শবাদী রাজনীতির আবেদন কোনও অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বের নিকট নহে, কোনও পূর্বনির্ধারিত ঠিক-ভুলের ধারণা দ্বারা চালিত নহে— এই রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে কতকগুলি নির্দিষ্ট নীতি, সমাজের স্বার্থে যাহার অনুশীলন আবশ্যিক বলিয়া তাহার প্রণেতা(রা) বোধ করেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেহরুর তিনটি আদর্শের কথা বহু-আলোচিত: গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। লক্ষণীয়, কোনওটিকেই নেহরু তাহার অন্তর্লীন ঔচিত্যের জন্য গ্রহণ করেন নাই। তিনি যে ভারত গড়িতে চাহিয়াছিলেন, তাহার জন্য এই তিনটি আদর্শকে অপরিহার্য জ্ঞানেই গ্রহণ করিয়াছিলেন। এবং, তাহার অনুশীলনে বিচ্যুতিহীন ছিলেন। ‘নেহরুগিরি’ শব্দটিকে যদি সংজ্ঞায়িত করিতে হয়, তবে আদর্শের মাপকাঠিতে আচরণ স্থির করিবার অভ্যাসটিকেই দেখিতে হইবে।
রাহুল তাঁহার রাজনৈতিক আচরণে নেহরুর স্তরে উত্তীর্ণ, এমন কথা তাঁহার পরম মোসাহেবও বলিবে না। ‘নেহরু’ হইয়া উঠা দীর্ঘ সাধনার ফল। কিন্তু, তাঁহার চিন্তাভাবনায়, রেটরিকে, যে নেহরুর দীর্ঘ ছায়া পড়িতেছে, তাহাও অনস্বীকার্য। ব্যক্তি-আক্রমণ বিষয়টি কুরুচিকর, শুধুমাত্র সেই কারণেই তিনি তাহাতে অরাজি নহেন— তিনি বোধ করেন, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিটি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। সেই আক্রমণ হইতে বিরত থাকিলে যদি রাজনৈতিক ক্ষতি হয়, তাহাও তিনি মানিতে সম্মত। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, তাঁহার এই অবস্থানটি দেশের গণভাবনার অনুসারী নহে, এক অর্থে তাহার বিপ্রতীপ— ভারতের জনমানস এখন কাদা ঘাঁটাকেই রাজনীতি জ্ঞান করে। হিংস্রতার রাজনীতির বিরুদ্ধেও যে গণতন্ত্রের স্বার্থেই শান্তির পথে থাকা জরুরি, এই কথাটি রাহুল স্মরণ করাইয়া দেন। অর্থাৎ, রাহুল গাঁধী সাম্প্রতিক কালে যে রাজনৈতিক ভাষ্যটি রচনা করিতেছেন, তাহার ভিত্তিতে আদর্শবাদের জমির আভাস মিলিতেছে। এখনও অবধি তাহা ভাষ্যমাত্রই। আভাসমাত্রও বটে। কিন্তু, এই মুহূর্তে আভাসটুকুও মূল্যবান।