বাবা তখন কংগ্রেস থেকে জিতে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। একই বাড়িতে থাকা ছেলে জয়প্রকাশ নারায়ণ-রাম মনোহর লোহিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টির সক্রিয় সংগঠক। বাবার আমন্ত্রণে বাড়িতে প্রাতরাশ সারতে এলেন নেহরু। সেই সময় দেশের যুব সম্প্রদায় যাঁকে ‘হিরো’ জ্ঞান করে, সেই নেহরুর প্রতি তত দিনে বিশ্বাসভঙ্গ হতে শুরু করেছে বছর বত্রিশের যুবকের। নেহরুর সঙ্গে প্রাতরাশের সুযোগ ছেড়ে গোটা সময়টা কাটালেন বাড়ির বাইরে।
অসন্তোষ ছিল, মতের অমিল ছিল। কিন্তু আজকের ‘নিউ ইন্ডিয়া’র মতো ঘেন্না ছিল না। কিছু নীতি নিয়ে প্রশ্ন-সংশয় থাকলেও আধুনিক ভারতবর্ষের নির্মাণে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা এবং তাঁর আদর্শের প্রয়োজনীয়তার কথা শেষ দিন অবধি স্মরণ করিয়ে দিতে যিনি দ্বিধা বোধ করতেন না, সেই রাজেন্দ্র সাচার-এর (ছবিতে) মৃত্যু আসলে এ দেশের একটি সংখ্যালঘু, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আদর্শের লড়াকু স্বরেরও মৃত্যু।
একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিবারে বড় হয়েছেন। আইনজীবী থেকে এক সময় দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও হয়েছেন। কিন্তু কখনও মাটি থেকে পা তোলেননি। কাউকে তোষণও করেননি। আমরণ লড়ে গিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে। এ দেশের পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার মুখোশ বার বার খুলে দিয়েছেন। আবার রাজনৈতিক-হিন্দুত্ববাদের ফন্দির সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, এ দেশের মুসলিমদের গায়ে আলাদা করে দেশপ্রেমের কাপড় জড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই।
অথচ দেশভাগের যন্ত্রণার সাক্ষী ছিলেন সাচার। পাকিস্তানে নৃশংস হিন্দু-নিধন স্বচক্ষে দেখেছেন। দিল্লি যাওয়ার পথে উল্টো ছবিটাও তাঁকে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছে। যে যেখানে সংখ্যালঘু, নিপীড়নের গল্পটা দিনের শেষে এক— এই উপলব্ধি সাচারের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের দিশা ঠিক করে দেয়। বিদ্বেষের বদলে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত অংশ, বিশেষ করে এ দেশের মুসলিমরা সাচারের হৃদয়ে এক গভীর সংবেদনশীল ভালবাসার ঠাঁই পেয়ে যান। আজ দলীয় রাজনীতি যখন হিন্দু আর হিন্দুত্বকে এবং ইসলাম আর সন্ত্রাসকে একাকার করে দিতে চাইছে, তখন সাচারের মতো নাগরিক অধিকার রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীর আরও বেশি করে দরকার হয়ে পড়েছে।
২০০৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ‘হাই-লেভেল কমিটি অন দ্য সোশ্যাল, ইকনমিক অ্যান্ড এডুকেশনাল স্টেটাস অব মুসলিম কমিউনিটি ইন ইন্ডিয়া’র রিপোর্ট (যা সাচার কমিটির রিপোর্ট নামেই অধিক পরিচিত) প্রকাশিত হওয়ার পরে দেশের আমজনতার কাছে (বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলমান সমাজে) রাজেন্দ্র সাচার একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। অবশ্য তার বহু আগে থেকেই নাগরিক অধিকার রক্ষার ইতিহাসে সাচার বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বিচারপতি থাকাকালীনই ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা জারির কট্টর সমালোচনা করেন। প্রতিদানে সিকিম থেকে রাজস্থানে বদলি করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। আবার দিল্লি হাইকোর্টে বিচারপতি থাকাকালীন ১৯৮৪-র শিখ দাঙ্গার মামলায় নিপীড়িতদের বিচার পাওয়ার ব্যাপারে সাচার সক্রিয় হতেই মামলাটি অন্য বেঞ্চে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতা-বিরোধী চরিত্রের কারণেই কি যোগ্যতা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার সুযোগ পাননি তিনি?
দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পরেও নিজেকে পাল্টাননি সাচার। যোগ দেন পিপল’স্ ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ’-এ (পিইউসিএল)। সেখানে ১৯৮৬-৯৫ অবধি সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। আবার নেতাদের ফোনে বেআইনি আড়ি পাতার মামলায় সুপ্রিম কোর্টে তাঁর সওয়ালের জেরেই নাগরিকদের উপরে রাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষেত্রে নির্দেশিকা তৈরি করতে বাধ্য হয় রাজীব গাঁধী সরকার। আধার মামলার বহু আগেই ওই মামলা নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার সম্পর্কে রাষ্ট্রকে ভাবতে শিখিয়েছিল। আবার পোটা-র মতো নাগরিক অধিকার হরণকারী ঘৃণ্য আইনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান সেনানী ছিলেন সাচারই। ২০০৪ সালের নির্বাচনী সংস্কারে প্রার্থীদের অপরাধের তথ্য দাখিল করাই হোক কিংবা আরও পরে নোটা— দুই ক্ষেত্রেই তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করতেই হয়।
তথ্যে মানুষের লড়াইটা জানা যায়। কিন্তু ব্যক্তিমানুষটাকে অনেকটাই আড়ালে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আর এই ব্যক্তি সাচারকে জানতে হলে আমাদের সাচার কমিটির রিপোর্টের আশ্রয়ে আসতে হবে। আজীবন যে দলের নীতির উল্টো দিকে অবস্থান করেছেন, সেই কংগ্রেসের ডাকেই এ দেশের মুসলিমরা কেমন আছেন, তা খোঁজার দায়িত্ব নিলেন সাচার। জনমানসে প্রচার পাওয়া ‘মুসলিম তোষণ’-এর ধারণাকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করল এই রিপোর্ট। শিক্ষা-আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলমান-স্বরের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটাকে সর্ব সমক্ষে বেলাগাম করল। রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে এই ‘সেকুলার রাষ্ট্র’-এর উন্নয়নের ফানুস চুপসে যেতে বেশি সময় লাগেনি। সারা দেশ ঘুরে তৈরি করা সেই রিপোর্ট দেখিয়ে দিল মুসলিমরা সব দিক থেকে কতটা অরক্ষিত। তারা তফসিলি জাতি ও জনজাতির থেকেও পিছিয়ে পড়েছে। এমনকী, এই ছবির কোনও পরিবর্তন হয়নি বাম-শাসিত রাজ্যগুলিতেও। বরং সাচার দেখিয়ে দিলেন, ২০০২ দাঙ্গা-উত্তর গুজরাতের মুসলিমদের থেকেও পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ। এই সত্য হজম হয়নি তৎকালীন শাসক দলের। তাঁরা ভূমি সংস্কারের আদিম গল্প শুনিয়ে আর দাঙ্গা থেকে ‘বাঁচানো’র দোহাই দিয়ে সত্যটাকে ধামাচাপা দিতে চাইলেন। অন্য দিকে, সাচার কমিটি অসাংবিধানিক, এই বলে মামলা ঠুকল গুজরাতের বিজেপি সরকার। মুসলমান সমাজের করুণ দশার চিত্র তুলে ধরার জন্য বাম-ডান, দুই তরফেই গালি খেয়েছেন সাচার!
মুসলিমদের নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিচারিতার গল্পটা যে বাম-ডান, দুই রাজনীতিতেই এক এবং আমাদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র যে দিনের শেষে মুসলমান সমাজকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক বই ভিন্ন কিছু মনে করে না— এই সার সত্য সবার সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি সাচার। এখানেই ব্যক্তি রাজেন্দ্র সাচার এবং তাঁর ‘আনপপুলার’ নীতি-আদর্শের আসল ছবিটা ফুটে ওঠে। যিনি বার বার মনে করিয়ে দিয়ে যান, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, গণতন্ত্রে সেই স্বরগুলিকেও কতটা সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। আজ যখন ‘মুসলিম তোষণ’ আর ‘বিপন্ন হিন্দু’র পরিকল্পিত বাইনারি-র মধ্যে এই দেশের দম আটকে আসছে, তখন সাচারের মতো এক একটা গল্প হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসটাকে আবার ফিরিয়ে আনার সাহস জোগায়।
ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক