ধর্ষণ: কে, কাকে, কেন

মধুমিতার এই পর্যবেক্ষণকে ভিত্তি করে আলোচনাটা আরও সম্প্রসারিত করা যায়। গোটা দেশ এই মুহূর্তে যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সেটা জরুরি বলেও মনে হয়।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১১:০৫
Share:

নির্ভয়ার ঘটনার পরে তরুণ গবেষক মধুমিতা পান্ডে তিহাড় জেলে বন্দি বিভিন্ন ধর্ষণ মামলার প্রায় ১০০ জন অপরাধীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ধর্ষণ প্রতিরোধের রাস্তা খুঁজতে হলে সবার আগে ধর্ষকের মনকে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। মধুমিতা অবাক হয়েছিলেন দেখে, অনেক অপরাধীই জেল খাটতে এসেও জানে না, তার অপরাধটা ঠিক কী। আইন বলে, অপরের অসম্মতিতে বলপূর্বক যৌন সংসর্গ করার নামই ধর্ষণ। কিন্তু এ দেশে একটা বড় সংখ্যক মানুষের কাছে এই সম্মতি বা অসম্মতি বস্তুটি আদৌ কী, সে সম্পর্কেই কোনও ধারণা নেই। ফলে তাঁরা যে কাজটা করছেন, সেটাকে যে ধর্ষণ বলে আর সেটা যে অপরাধ, এই বোধও তাঁদের মনে তৈরি হয়নি।

Advertisement

মধুমিতার এই পর্যবেক্ষণকে ভিত্তি করে আলোচনাটা আরও সম্প্রসারিত করা যায়। গোটা দেশ এই মুহূর্তে যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সেটা জরুরি বলেও মনে হয়। সত্যি বলতে কী, প্রতি দিন দেশের বিভিন্ন কোণে ধর্ষণের যত ঘটনা ঘটে, তার থেকে যেটুকু সংবাদমাধ্যমের গোচরে আসে, সেগুলো সব যদি প্রতি দিন সবিস্তার লেখা হয়, তা হলে গোটা সংবাদপত্র শুধু ধর্ষণের খবর লিখেই ভরে যাবে। আট মাস বয়সের শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধা, কেউই বাদ যাবেন না। ধর্ষকের বয়সও আট থেকে পঁচাত্তর অবধি অনায়াস ঘোরাফেরা করবে।

মুশকিল হল, বেশির ভাগ খবরই আমাদের কাছে শেষমেশ শুধুই ধর্ষণের খবর হয়ে থেকে যায়। ‘ধর্ষণ’ শব্দটা একটা ছাতার মতো শুধুমাত্র অপরাধের একটি প্রকরণকে জানান দিতে থাকে। কিন্তু সেই প্রকরণটির পিছনে আরও কত পরত ছিল, কত ধরনের বিকার ছিল, মনের কত রকম অন্ধকার ছিল, ক্ষমতার কত স্তরের বুনট ছিল, সেগুলো বহুলাংশে অজানা রয়ে যায়। তার সঙ্গে যখন ‘এমন তো কতই হয়’ বা ‘সাজানো ঘটনা’ বা ‘জিন্‌স পরলে তো এ রকম হবেই’ গোছের বাণী শাসকের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতে থাকে (কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিবারও বললেন, এত বড় দেশে এমন একটুআধটু তো হবেই!), তখন একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে। এক দিকে অপরাধগুলো সমাজের একটা বড় অংশের চোখে লঘু হয়ে যেতে থাকে, অন্য দিকে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ অনেকাংশে এই রাজনৈতিক অসংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে মনোনিবেশ করে। সেটা খুবই সঙ্গত এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশ জুড়ে প্রতি দিন আরও যে শত শত কাঠুয়া আর উন্নাও ঘটেই চলেছে, তার উৎসভূমিটিকে চিহ্নিত করার কাজটা যেন আড়ালে চলে না যায়।

Advertisement

সম্মতি আর অসম্মতির ধারণা এবং তাকে মান্য করার অভ্যাস গড়ে ওঠার পূর্বশর্ত হল ব্যক্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার চেতনা তৈরি হওয়া। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ প্রথমত এখনও এই ব্যক্তিভিত্তিক জীবনদর্শনে অভ্যস্ত নয়। দ্বিতীয়ত ব্যক্তিচেতনা তা-ও যতটুকু বা সেঁধিয়েছে, মেয়েদের ব্যক্তি হিসেবে দেখার চোখ আদৌ তৈরি হয়নি। ইচ্ছে হলেই কেন যে কোনও মেয়ের গায়ে হাত দিতে নেই— এই বোধটুকু এ দেশের পুরুষসমাজের একটা বড় অংশের কাছে অধরা। ফলে সম্মতির অপেক্ষা তো দূর, মেয়েরা চিৎকার করলে বা হাত-পা ছুড়লেও তারা নিরস্ত হবে, এমন নয়। যা চাই, তা ছলে বলে কৌশলে হস্তগত করাই তাদের কাছে পুরুষের স্বাভাবিক ধর্ম। সেই ধর্ম পালনের জন্য কেন অপরাধী হতে হবে, এটা বোঝাই দুষ্কর।

ধর্ষণের মতো অপরাধকে কোনও অভিন্ন খোপে বুঝতে চাওয়া উচিত নয়। যুদ্ধ বা দাঙ্গাহাঙ্গামার সময়ে ধর্ষণকে যখন পরিকল্পিত রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার পিছনে এক রকমের মন। নারী এখানে সম্প্রদায়ের ইজ্জতের প্রতীক হয়ে উঠছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা পুরনো কোনও অপমানের বদলা নিতে যখন নির্দিষ্ট কাউকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, তার পিছনে আর এক রকমের মন। নারী সেখানে শত্রুবিশেষ। আবার বন্ধুরা মিলে নেশাতুর অবস্থায় খানিক ফুর্তি করতে যখন কোনও মেয়েকে ধরে আনা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন মন। প্রেমিকা বা স্ত্রীর প্রতি বিশেষ মুহূর্তে বলপ্রয়োগ করা বা নিজের অধীনস্থ কারও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে, হয়তো বা কিছু পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাকে যৌন সংসর্গে বাধ্য করা কিংবা নিজের অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে নিজের চেয়ে ওপরতলার কোনও নারীকে ধর্ষণ করার পিছনেও কিন্তু আলাদা আলাদা মন। সুতরাং ধর্ষণ মানেই যৌন ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়না যেমন নয়, একই ভাবে ধর্ষণ মানেই শুধু ক্ষমতা কায়েম বা বাগে আনার চেষ্টাও নয় বোধ হয়। বাবা যখন মেয়েকে ধর্ষণ করছে বা দাদু নাতনিকে, তার পিছনে কোন মন? যে মন বা মনের অভাব থেকে হুলো বেড়াল মাঝে মাঝে নিজের ছানাদের খেয়ে ফেলে, সেটাই কি?

কাঠুয়ায় আট বছরের মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা শুনে এখন শিউরে উঠছেন সবাই। পাঁচ বছরের মেয়ের শরীর থেকে বোতল বেরিয়েছিল দিল্লিতে। ওই দিল্লিতেই, সম্প্রতি ইনদওরেও আট মাসের শিশু ধর্ষিত হয়েছে। যে চোখ আজ আট মাসের কচি শরীরে নারীত্ব খুঁজে পায়, সেই চোখ কি আর কাউকে রেয়াত করবে? না কি ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আটকাতেই শিশুদেহে আক্রমণ? কোন ক্ষমতার তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা হবে এর? কী ভাবেই বা ব্যাখ্যা করব আট-দশ-বারো বছরের বালক কেন ধর্ষক হয়ে যায়? যেমন হচ্ছে প্রায়শই। আমরা কি জেনেছি, ওই বালক নিজে তার আগে নিগ্রহের শিকার হয়েছিল কি না? সেই অভিজ্ঞতাই তাকে শিকার থেকে শিকারি করে তুলেছে কি না? হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। পর্নোগ্রাফির অবারিত দুনিয়া। মুঠোয় থাকা ক্যামেরা বন্দি করতে পারে যা কিছু। ওই বালকের মনোজগৎ কি আর বালকোচিত আছে? আর এই যে আমরা, পাঁচ বছরের সন্তান হিন্দি গান গেয়ে কোমর দোলাতে শিখেছে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছি, রিয়েলিটি শো-এ পাঠাব কি না ভাবছি আর বিশেষ বিশেষ পোশাকের মিনি সংস্করণ কিনে পরাচ্ছি যত্ন করে, আমরাও ঠিক অভিভাবকোচিত আছি তো?

ব্যক্তিচেতনায় দীক্ষা অসম্পূর্ণ! ব্যক্তিভোগ্য ষোড়শোপচারের পসরা হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। নীতিপুলিশি না করেও বলা যায়, সম্পদ ও শিক্ষার উৎকট বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা সমাজ যখন লালসার সাধনায় মাতে, তখন বিকারের এমন মহামারি জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন