বিজ্ঞানের পথে মত বদলায়
Health

‘হু’ বিষয়ে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলি দুর্ভাগ্যজনক, বিপজ্জনকও

ড্রপলেট কত দূর ছড়াতে পারে, তাই নিয়েই ধন্দ। ফিতে মেপে বলা মুশকিল, কিন্তু তার দৌড় মোটামুটি ৬ ফুট।

Advertisement

সুমিত সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

নতুন কোনও রোগ সম্বন্ধে নতুন কোনও তথ্যপ্রমাণ হাতে এলে বিজ্ঞানীরা সেই নতুন তথ্যের সাপেক্ষে নিজেদের মত পরিমার্জন করবেন, বা পাল্টাবেন— সেটা স্বাভাবিক। অপরিহার্যও বটে। কোনও পক্ষে অনড় হয়ে বা অনমনীয় সংস্কারকে আঁকড়ে বসে থাকেন না তাঁরা। জ্ঞান আহরণ করেন, নিজেদের মত শুধরে নেন। এতে বিজ্ঞানের জঙ্গমতাই প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞান তো আর অপরিবর্তনীয় শিলালিপি নয়— যুক্তি মেনে পাল্টানোই তার ধর্ম।

Advertisement

মুশকিল হল, কিছু নেতা বলতে শুরু করেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন বা হু) কোভিড-১৯ অতিমারি বিষয়ে পৃথিবীকে ঠিকঠাক জানাতে পারেনি। কথাটা বিপজ্জনক রকম গোলমেলে। বিভিন্ন সময়ে হু অতি সতর্ক ভঙ্গিতে যে ঘোষণাগুলো করেছে, যে আপডেট দিয়েছে, সংবাদমাধ্যমের একাংশ সেটাকে প্রচার করেছে অতিমারি সম্বন্ধে হু-র পাকাপোক্ত অবস্থান হিসেবে। নেতারাও সেই কথাটায় বিশ্বাস করে বসেছেন।

হু-র নিজস্ব নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, অতিমারির গোড়া থেকেই তারা মানুষকে পরিষ্কার পরামর্শ দিয়ে আসছে। স্থানীয় প্রশাসনগুলি যখন যা জানিয়েছে, হু শুনেছে। তার ভিত্তিতেই মতামত বদলেছে। তাই তারা পৃথিবীকে বিভ্রান্ত করছে— এই অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ভুয়ো।

Advertisement

১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হু-র বিবৃতিতে বলা হয়, চিনা কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক সমীক্ষায় করোনাভাইরাসের ‘মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনও স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি’। সে দিনই এই রোগের রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট-এ হু জানিয়েছিল, “মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হয় কি না, সংক্রমণের বাহক কী, কোথায় উভয়ের সংযোগ হচ্ছে, অসুখ ধরা পড়েনি এমন উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গের কোনও রোগী আছেন কি না— এ সব নিশ্চিত করতে আরও পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন।” শর্তসাপেক্ষ বিবৃতি। অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মতও। কারণ, তখনও যত তথ্য মিলেছে, তার উপরে ভর করেই তা প্রকাশিত। কিন্তু, সংবাদমাধ্যম এই বিবৃতিটাকেই ধরে নিল স্বাস্থ্য সংস্থার চূড়ান্ত বক্তব্য হিসেবে। বলা হল, হু জানিয়েছে যে কোভিড মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। আরও তথ্য হাতে আসা মাত্রই ১৯ জানুয়ারি হু জানাল, মানুষ থেকে মানুষে সীমিত ভাবে রোগটি যে ছড়ায়, তার প্রমাণ মিলেছে। ২১ জানুয়ারি হু মানুষে-মানুষে সংক্রমণ হওয়ার কথাটিতে সিলমোহর দেয়; ২২ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন ইমার্জেন্সি কমিটি-র সম্মেলন ডাকে। ৩০ জানুয়ারি আবার সম্মেলন ডাকা হয়। সে দিনই কোভিড-১৯’কে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। তখনও পর্যন্ত চিনের বাইরে ১৮টি দেশে সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছিল। রোগীর সংখ্যা ৯৮ জন, চিনের বাইরে তখনও কেউ মারা যাননি। তার পর বেশ কয়েকটি অ্যাডভাইজ়রি প্রকাশ করে হু। শেষ পর্যন্ত ১১ মার্চ সংস্থার মহানির্দেশক কোভিড-১৯’কে অতিমারি ঘোষণা করলেন। জানালেন, অতিমারির প্রকোপ কমানোর উপায় সব দেশের হাতে আছে। তারা ঠেকাতে পারবে কি না, সেটা প্রশ্ন নয়; ঠেকাতে চাইবে কি না, প্রশ্ন সেটাই।

জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মাস্ক সংক্রান্ত নীতি বদল করছে। সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন), পিএইচই (পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড), ইসিডিসি (ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজ়িজ় প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল) এবং হু-র পরামর্শ ছিল, যে রোগীদের উপসর্গ আছে, তাঁদের মাস্ক পরতে হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সার্স-এর পূর্ব-অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকুই জানা ছিল। পরে জানা গেল, উপসর্গহীন ও উপসর্গ তখনও দেখা দেয়নি, এমন রোগীর থেকেও রোগটি ছড়ায় এবং এই দিক দিয়ে অন্য ভাইরাসের চেয়ে করোনা বেশি ভয়ঙ্কর। এই নতুন তথ্য আসার পর সকলের জন্য মাস্ক পরার নীতি ঘোষণার প্রয়োজন হল। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিন্তু আগের অবস্থানের বিরোধ নেই— তথ্যপ্রমাণ অনুসারেই তো নীতি গ্রহণ করতে হবে। অতিমারি প্রতিরোধের নীতি অপরিবর্তনশীল হতে পারে না।

হু-র সীমাবদ্ধতার কারণ অন্যত্র। প্রথমত, সংস্থাটি অতি সীমিত বাজেটে চলে। যেখানে স্বাস্থ্যখাতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ সাড়ে তিন লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট হল মাত্র ২৪০০ কোটি ডলার। দ্বিতীয়ত, সংস্থাটি কেবল পরামর্শই দিতে পারে— হাতেকলমে পরিবর্তন ঘটনার সামর্থ্য তার কার্যত নেই। তৃতীয়ত, তথ্য সংগ্রহের জন্যই হোক বা নীতি প্রয়োগের জন্য, বিভিন্ন দেশের আমলা, রাজনীতিবিদ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া হু-র উপায় নেই। সংস্থাটির কাজ হল সদস্য দেশগুলি থেকে তথ্য জোগাড় করা। সেই তথ্য স্থানীয় রাজনীতির স্বার্থে রাঙানো হবে, সেই আশঙ্কা প্রবল। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হু চমৎকার কাজ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ হু-র নির্দেশিকা মেনেছে। আমেরিকা ও ব্রিটেন-সহ যে দেশগুলি এই নির্দেশিকা মানেনি, তাদের চেয়ে ভাল ফলও পেয়েছে।

এই মুহূর্তে বড় প্রশ্ন, কোভিড-১৯ কি বাতাসবাহিত? এই পরিপ্রেক্ষিতে আবার অভিযোগ, হু নিজের আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে। অভিযোগটা ঠিক নয়। ইংরেজি ভাষায় ‘এয়ারবোর্ন’ বা বাতাসবাহিত বলতে যা বোঝায়, কোভিড-১৯ প্রশ্নাতীত ভাবে তাই। হাঁচলে, কাশলে, গান গাইলে, চেঁচালে— মুখ থেকে নিঃসৃত ড্রপলেটস বা জলকণার মাধ্যমে বাতাসে ভেসে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘এয়ারবোর্ন’ শব্দটির প্রয়োগ কিছু আলাদা। ড্রপলেটস একটুখানি যেতে না যেতেই মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু, ড্রপলেট নিউক্লিয়াই (এরোসল, অর্থাৎ একেবারে ক্ষুদ্র জলকণা) মাধ্যাকর্ষণে আটকায় না। তার আর সরলরেখায় চলার দায় থাকে না, সেই কণা বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে ভেসে বেড়ায়। খালি চোখে সেগুলো দেখা যায় না। সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিং মেশিনের মাধ্যমে সেই ভাইরাস হোটেল, হাসপাতালের এক তলা থেকে অন্য তলায় পৌঁছয়। কোভিডের ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত ভাবেই ঘটেনি। হাসপাতাল, হোটেল, প্রমোদতরী, কোথাও এ ভাবে সংক্রমণ ছড়ায়নি।

ড্রপলেট কত দূর ছড়াতে পারে, তাই নিয়েই ধন্দ। ফিতে মেপে বলা মুশকিল, কিন্তু তার দৌড় মোটামুটি ৬ ফুট। কিন্তু ৬ ফুট ১ ইঞ্চি দূরত্বে দাঁড়ালেই কেউ সম্পূর্ণ নিরাপদ নন! ভাইরাসটি যত বেশি দূরত্ব যাবে, সেই হারেই তার কার্যক্ষমতাও কমবে— রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাও। কিন্তু দূরত্বই একমাত্র কারণ নয়। ভাইরাসের পরিমাণ (শ্লেষ্মাভর্তি হাঁচি), কোন গতিতে তা উৎস থেকে বেরিয়েছে (হাঁচি, কাশি, গান গাওয়া ও কথা বলার সময়ে বেরনো জলকণার গতি এক হবে না), ভাইরাসযুক্ত পরিবেশে কে কত ক্ষণ ছিলেন, চার পাশে বায়ুচলাচল কেমন ছিল (প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম) এবং অবশেষে দূরত্ব— সব কারণেরই নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে।

একটি তথ্য বেশ ভরসা দিচ্ছে। উপসর্গ আছে এমন রোগীদের সঙ্গে পাঁচ দিন পর্যন্ত এক বাড়িতে কাটালেও কিন্তু সর্বত্র এক হারে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে না। সেই হার ২% থেকে ১৭%। রোগীর সঙ্গে পাঁচ দিন কাটানোর পরও তাইওয়ানে প্রতি একশো জনে দু’জন সংক্রমিত হয়েছেন, আর চিনে হয়েছেন ১৭ জন। উল্লেখ্য, কোনও ক্ষেত্রেই মাস্ক ব্যবহৃত হয়নি।

ইনটিউবেশন, অর্থাৎ সরাসরি শ্বাসনালীতে নল লাগানোর মতো কিছু ক্ষেত্রে এরোসল তৈরি হয়। সেটা বাদ দিলে, বিভিন্ন কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্রের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সেখানকার বাতাসে ভাইরাস টিকে থাকার প্রমাণ কেউই পাননি। স্বাস্থ্যকর্মীরা সার্জিক্যাল মাস্ক পরে কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসছেন। এতে যে তাঁদের মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে, এমন খবর নেই। সার্জিক্যাল মাস্ক কিন্তু এরোসলের মাধ্যমে সংক্রমণ আটকাতে পারে না। অর্থাৎ, রোগ বিস্তারে এরোসলের ভূমিকা নগণ্য। মোট কথা, ‘এয়ারবোর্ন’ এরোসলের মাধ্যমে সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে বটে, কিন্তু সেই পথে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম বলেই অনুমান করা চলে।

গত বছর পর্যন্ত আমরা কোভিড-১৯ নামক রোগটির অস্তিত্বের কথাই জানতাম না। রোগটা সম্বন্ধে আমরা যা জেনেছি, সবই গত ছ’মাসে। ঘটনা হল, মানবসভ্যতার ইতিহাসে আর কোনও রোগের ক্ষেত্রে প্রথম ছ’মাসে এত কথা জানা যায়নি, কোভিড-১৯ সম্বন্ধে আমরা যা জানি। মিডিয়ায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে, এই মুহূর্তে তার প্রতিবাদ করা, তাকে খণ্ডন করাও বিজ্ঞানমনস্কতার অন্যতম দায়িত্ব।

শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন