নিজস্ব প্রত্যাহারেও তিনি স্বতন্ত্র

নিষ্কর্মা সন্ন্যাস বিবেকানন্দের আদর্শ নয়। ধ্যানযোগ যেমন চাই, তেমন চাই কর্মযোগ। দেশের জন্য কর্ম।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:৫৯
Share:

আগামী কাল স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৭তম জন্মতিথি.

স্বামী বিবেকানন্দ কতটা কাজের মানুষ, তা গুরুভাইরা ক্রমে টের পেলেন। আমেরিকা ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে বিবেকানন্দ ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশ ও দশের কাজে। সরলা দেবীর স্মৃতিকথা জীবনের ঝরাপাতা’য় গুরুভাইদের প্রতিক্রিয়ার কথা আছে। তাঁরা খানিক কৌতুক করেই বলেছেন, বেশ ছিলাম, জপ-ধ্যানে সময় কাটাতাম। নরেন বিলেত থেকে ফিরে এসে অবধি শুধু কাজ আর কাজ, কেবল কাজের কথা বলছে।

Advertisement

সেই কাজ একদিক থেকে নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কর্মা সন্ন্যাস বিবেকানন্দের আদর্শ নয়। ধ্যানযোগ যেমন চাই, তেমন চাই কর্মযোগ। দেশের জন্য কর্ম। বিবেকানন্দের চিঠিপত্রে কাজের নানা রকম কথা ও নির্দেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অখণ্ডানন্দকে ১৯০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চিঠিতে লিখছেন, “এই ঘোর দুর্ভিক্ষ, বন্যা, রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বলো? খালি ‘আমাদের হাতে রাজ্যশাসনের ভার দাও’ বললে কি চলে? কে বা শুনছে ওদের কথা? মানুষ যদি কাজ করে— তাকে কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়?” সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই বিবেকানন্দের গুরুভাই অখণ্ডানন্দ অনাথাশ্রম গড়ে তুলেছেন। বিবেকানন্দ লিখছেন তাঁকে, ‘নিঃশব্দে দু-একজন অসাধারণ পুরুষ নানা বিঘ্ন-বিপত্তির মধ্যে নিঃসাড়ে কাজ করে।’

অখণ্ডানন্দ ভাগলপুরে কেন্দ্র স্থাপন করতে চান। বিবেকানন্দের স্পষ্ট নির্দেশ, ‘আমাদের mission হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভূষোর জন্য; আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য।’ বিবেকানন্দের সেবাকর্মের মধ্যে শ্রেণি-চেতনা সচেতন ভাবেই ক্রিয়াশীল। সহোদর সমাজবাদী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সাধে কি সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের চিন্তায় সমাজবাদের সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। বিবেকানন্দের তখন প্রয়াণ হয়েছে। ভূপেন্দ্রনাথ দাদার কাজ-কর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন অন্যদের কাছে। বিবেকানন্দের শিষ্যা নিবেদিতাও যখন এ দেশে তখন তিনি বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কত যে কাজ করছেন। প্লেগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য-সচেতনতা প্রদান, শিক্ষাপ্রদান— নিবেদিতার কাজের শেষ নেই। রাজনৈতিক পরিসরে নয়, কাজগুলি হচ্ছে সামাজিক পরিসরে।

Advertisement

বিবেকানন্দের জীবনের শেষ দু-বছর তাঁর চিঠিপত্রে আবার মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার কথা। নিবেদিতাকে লিখছেন ৪ মার্চ ১৯০০ সালের চিঠিতে, ‘আমি আর কাজ করতে চাই না— এখন বিশ্রাম ও শান্তি চাই।’ তুরীয়ানন্দকে লিখছেন ১৯০০ সালের অগস্ট মাসে, ‘এখন তোমরা যা হয় কর। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি, বস্‌। গুরুমহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম – প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি।’ কেন কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন তিনি? লিখেছেন, ‘আমার শরীর-মন ভেঙে গেছে। বিশ্রাম অত্যাবশ্যক।’ উনিশ শতকে এই যে সামাজিক কাজের আদর্শ, হিতবাদ-পরোপকারের আদর্শ গড়ে উঠেছিল তাতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন যাঁরা তাঁদের অনেকেই শেষপর্বে নিজেদের সেই কর্মময়তা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন তো প্রত্যাহারেরই জীবন। বিবেকানন্দও শরীর-মন ভেঙে পড়ার কথা লিখেছেন। নিজেকে প্রত্যাহার করার আগে কিছু ব্যবস্থা অবশ্য করতে হয়েছিল কাজের মানুষটিকে। মিস্টার ক্রিস্টিনকে প্যারিস থেকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমেরিকায় উপার্জিত সব টাকা ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার আমি মুক্ত, পূর্বের মতো ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, মঠের সভাপতির পদও ছেড়ে দিয়েছি।’ কাজের চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করার অন্য কারণও ছিল। ‘আমি যতক্ষণ থাকব, আমার উপর ভরসা করে সকলে অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে যাবে।’ গুরুভাইরা যাতে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, তাঁর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে না পড়েন সে-জন্যও তাঁর সরে আসা চাই।

তুরীয়ানন্দকে লিখেছিলেন: আমি এখন জিরেন নিতে চলেছি। জিরেন নিতে গেলে মনের কথা সহজে বলা চলে। বৌদ্ধধর্মের প্রতি আগে বহুক্ষেত্রে খড়্গহস্ত ছিলেন। জীবনের শেষপর্বে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের লেখা মন দিয়ে পড়ছেন। বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে মত ইতিবাচক হচ্ছে সে কথা জানাচ্ছেন। বুদ্ধদেব, বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী পর্যায়ের বিচ্যুতি প্রতিটি বিষয় তাঁর কাছে পৃথক ভাবে ধরা পড়ছে। কাজের থেকে দূরে আছেন বলে পড়ার সময় পাচ্ছেন বেশি, ভাবার সময়ও। কয়েকটি না-মানুষী পোষ্য গ্রহণ করেছেন। হাঁসটির প্রতি স্নেহের ও মনোযোগের শেষ নেই।

এই যে প্রান্তবেলার বিবেকানন্দ, মনে রাখতে হবে, তখনও কিন্তু তিনি চল্লিশ অতিক্রম করেননি। করবেনও না। ১৯০২ সালে প্রয়াণ হবে তাঁর। জীবনের কর্মের কোলাহল ও প্রত্যাহারের নির্জনতা দুইয়ের মধ্য দিয়েই গিয়েছেন তিনি। তাঁর পত্রাবলী মানুষটিকে বড় সজীব করে তোলে। আর আমাদের মনে হয় কাজও যেমন সত্য, কাজ থেকে সরে আসাও সত্য। কাজও চাই, ছুটিও দরকার।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন