মহামারি

মোবাইল মহামারির কোনখানে শেষ, আদৌ শেষ আছে কি না, কে জানে। সমীক্ষার পর সমীক্ষায় দেখা যাইতেছে, মোবাইল মানুষকে সমাজবিচ্ছিন্ন, অসামাজিক, বাস্তবরহিত করিয়া তুলিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

উত্তরপ্রদেশের কুশীনগর জেলায় এক রেল-ক্রসিংয়ে ট্রেনের সহিত ধাক্কা লাগিল স্কুলভ্যানের এবং মারা যাইল ১৩টি শিশু, যাহাদের বয়স সাত হইতে এগারোর মধ্যে, অন্য চার শিশু ও চালকের অবস্থাও সঙ্কটজনক। বাঁচিয়া যাওয়া একটি শিশু জানাইয়াছে, ‘ড্রাইভারকাকু’কে তাহারা বারংবার চিৎকার করিয়া ধাবমান ট্রেনটি সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছিল, কিন্তু সে শোনে নাই, কারণ মোবাইলে কথা বলিতেছিল। ঘটনার সাক্ষী কিছু পথচারী বলিয়াছেন, সে মোবাইলে ইয়ারফোন লাগাইয়া গান শুনিতেছিল, পথচারীরাও সাবধান করিয়াছিলেন, সে শোনে নাই। এই মোবাইল মহামারির কোনখানে শেষ, আদৌ শেষ আছে কি না, কে জানে। সমীক্ষার পর সমীক্ষায় দেখা যাইতেছে, মোবাইল মানুষকে সমাজবিচ্ছিন্ন, অসামাজিক, বাস্তবরহিত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু কেবল তাহাতেই ক্ষতি সীমাবদ্ধ থাকিলে মানুষ নিজ দায়িত্বে উৎসন্নে যাইবার অধিকার লইয়া তর্ক করিতে পারিত, ইহাও দেখা যাইতেছে, মোবাইলে কথা বলিতে বলিতে রেললাইন দিয়া হাঁটিতে গিয়া কত মানুষ প্রাণ হারাইতেছেন, বিপজ্জনক ভাবে নিজস্বী তুলিতে গিয়া কত জন মারা যাইতেছেন। গাড়ি চালাইতে চালাইতে মোবাইলে বাক্যালাপ এখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা, বহু চালক এই ভাবে কথা বলিতে ব্যস্ত থাকে ও নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া অন্য গাড়িতে ধাক্কা মারে, তাহার পর অবশ্য দ্রুত গাড়ি চালাইয়া পলায়ন করে, তখন ফোনে কথা বলা কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ রাখে। পুলিশ বারংবার বারণ করিতেছে, এমনকী কোনও গাড়ির চালক মোবাইলে কথা বলিতে বলিতে চালাইতেছে দেখিলে অন্য কেহ যেন সেই চালকের ছবি তুলিয়া পুলিশের অমুক নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করিয়া দেন, তাহার বিশাল বিজ্ঞাপনও দেওয়া হইতেছে, কিন্তু কাহারও হেলদোল নাই। নিজের নেশায় মাতিয়া নিজের ও বিশেষত অন্যের প্রাণসংশয় ঘটাইলে, তাহা দায়িত্ববোধের সামূহিক অভাবের পরিচায়ক। আত্মপ্রশ্রয় ও নাছোড় আমোদপ্রবণতা আসিয়া দায়বোধকে ছুড়িয়া ফেলিয়াছে।

Advertisement

রেল কি তাহার দায়িত্ব যথাযথ পালন করিয়াছে? ওই স্থানে প্রহরাসম্পন্ন লেভেল ক্রসিং ছিল না কেন? রেলমন্ত্রী হইয়াই পীযূষ গয়াল ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭-র প্রথম মিটিংয়েই বলিয়াছিলেন, এক বৎসরের মধ্যে নিশ্চিত করিতে হইবে, ভারতে একটিও প্রহরাহীন লেভেল ক্রসিং নাই। তাহার চেষ্টা চলিতেছে, এখন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বলিতেছেন, ৩১ মার্চ ২০২০-র মধ্যে এই লক্ষ্য তাঁহারা পূরণ করিবেন। দেশে এখনও ৫৭৯২ প্রহরাহীন লেভেল ক্রসিং রহিয়াছে। এই নির্দিষ্ট ক্রসিংটিতে কোনও বাধাপ্রদানকারী লৌহদণ্ড বা অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল না, কেবল এক জন ‘গেট-মিত্র’ মোতায়েন ছিলেন, যিনি স্থানীয় মানুষদের দ্বারা নিযুক্ত। কিন্তু ধাবমান গাড়ির মোবাইলমগ্ন চালককে থামাইবার জন্য এক জন মানুষের ইশারা বা চিৎকৃত নিষেধ যথেষ্ট নহে।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী দুর্ঘটনাস্থলে আসিয়া দেখিলেন, বহু মানুষ ক্ষোভ জানাইতেছেন, স্লোগান দিতেছেন, ওই স্থানে প্রহরাসম্পন্ন লেভেল ক্রসিংয়ের দাবিতে। দেখিয়া বলিলেন, ‘নাটক করিবেন না!’ এতগুলি শিশু মারা যাইবার পর যখন জনতা দুঃখে ক্ষোভে আত্মহারা হইয়া একটি সঙ্গত দাবিতে মুখর, তখন তাঁহাদের সুষ্ঠু জীবনের বন্দোবস্ত করিবার দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটি, নিজের ক্ষমতার বেদি হইতে চরম অবজ্ঞায় কথা ছুড়িয়া দিলেন, বিদ্রুপ করিলেন, তাঁহাদের আবেগকে ‘নৌটঙ্কি’ বলিয়া ঠেস দিলেন। এই চূড়ান্ত অনুভূতিহীনতা, এই সহমর্মিতার প্রকট অভাব, এই অভব্যতাও এক মহামারি, যাহা ভারতের রাজনীতি ও সমাজজীবনকে ফোঁপরা করিয়া, বহু নেতানেত্রীকেই প্রকৃত দায়িত্ব হইতে চ্যুত করিতেছে। কেহ হয়তো কেবল বিদ্বেষের ব্যাকরণ শিখিয়া, মানুষকে মূলগত ভাবে অশ্রদ্ধা করিতে শিখিয়া ও শিখাইয়া গদিতে চড়িয়া বসিয়াছেন। তাঁহার পক্ষে মানুষের সমব্যথী হইবার ধারণাটিও আয়ত্ত করা অসম্ভব, তাহার প্রয়োগ তো দূরের কথা। ইঁহারা গণতান্ত্রিক দেশে নেতৃত্ব বস্তুটিকে আংশিক স্বৈরাচারের অধিকার হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। মৃত্যু মানুষকে স্বভাবত কিঞ্চিৎ বিনয়ী করে, শোকের স্থানে যাইয়া স্বর আপনিই নামিয়া আসে। এই যোগীদের সেই বুনিয়াদি নম্রতাটুকুও নাই। ইহা এক কর্কশ সদা-উদ্ধত বলদর্পী সংস্কৃতির অংশ, যাহা যথেচ্ছ ও লাগামহীন মোবাইল ব্যবহারের ন্যায়ই পরোয়াহীন, জীবনধ্বংসী। কোন প্রহরায় ইহাকে রোধ করা যাইবে?

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

তার মানে প্রায় সকলেই অমাংস কুমাংস খেয়েছি। কোনও ধর্মে গরু খাওয়া বারণ, কোনও ধর্মে শুয়োর। সব ধর্মেই বোধ হয় ছুঁচো/বাঁদর/বেড়াল/মোষ/কুকুর নিষিদ্ধ। তার অর্থ, সব্বার জাত গিয়েছে। হ্যাঁ, তা ঘটেছে অজ্ঞানে, কিন্তু বিজ্ঞান বলে, খাওয়া ইজ খাওয়া। জাত যখন চলেই গিয়েছে, তখন আর জাতিবিদ্বেষ বজায় রেখে লাভ কী? দাঙ্গা করে, বা দাঙ্গাবাচক ফেসবুক এন্ট্রি লিখে শক্তিক্ষয় করার মানেই নেই। মহাপুরুষরা শত বুঝিয়েও পারেননি, ভাগাড়-দুর্নীতি পেরে দেখাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন