রেস্তোরাঁতে সাবধান

ক্রেতারা ক্ষুব্ধ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। নামীদামি রেস্তোরাঁ এত টাকা নিয়েও কেন পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর খাবার দেবে না? ক্রেতাসুরক্ষার দিক থেকে দেখলে এমন ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

Advertisement

অমিতাভ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৭ ১৪:১০
Share:

স ম্প্রতি কলকাতার কিছু রেস্তোরাঁর হেঁশেল, রাস্তার দোকানে হানা দিয়েছেন পুরকর্তারা। ফ্রিজ থেকে বেরিয়েছে পচা, ছত্রাক-পড়া খাবার। উচ্ছিষ্ট ফের পরিবেশনের নিদর্শন মিলেছে। শরবতে ব্যবহার হচ্ছে মর্গের বরফ।

Advertisement

ক্রেতারা ক্ষুব্ধ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। নামীদামি রেস্তোরাঁ এত টাকা নিয়েও কেন পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর খাবার দেবে না? ক্রেতাসুরক্ষার দিক থেকে দেখলে এমন ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলে মনে রাখতে হবে, খাবারে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির কোনও শ্রেণিবিভেদ নেই। ফুটপাথে যে রাঁধছে, তার খাবারে বৈচিত্র কম থাকতে পারে, স্বাদ-গন্ধে একটু মন্দ হতে পারে। কিন্তু সুরক্ষিত, নিরাপদ খাবার প্রত্যেককেই তৈরি করতে হবে। প্রায়ই দেখি, ফুটপাথের দোকানে নুডলস সেদ্ধ করে মশারিতে ঢেলে নর্দমার ঝাঁঝরির উপর রাখা রয়েছে। গরম ভাপে ভিতর থেকে পোকা এসে বসছে তার উপর। এটা মেনে নেওয়া ততটাই অন্যায়, যতটা উচ্ছিষ্ট পরিবেশন করা। এ দুটোই সমান অপরাধ। স্ট্রিট ফুড সব দেশেই বিক্রি হয়। তা অপরিচ্ছন্ন হবে কেন?

জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে দেখলে খাদ্যের ক্রেতা আর খাদ্যের উৎপাদক, দু’জনেরই স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হবে। যিনি রান্না করছেন, কাজের পরিবেশ তার জন্য স্বাস্থ্যকর, স্বস্তিদায়ক হতে হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, রেফ্রিজারেশন যদি না থাকে, এবং সর্বোপরি হাইজিন সম্পর্কে ধারণা যদি না থাকে, তা হলে সংক্রমণ হবেই, এবং তা রন্ধনকর্মীর জন্যও বিপজ্জনক। যে রান্না করছে, সে যদি অসুস্থ হয় তবে তার তৈরি খাবার অন্যের ক্ষতি করবে। বিদেশে দেখেছি, শেফ অসুস্থ হয়ে পড়লে যদি উৎপাদন বন্ধ হয়, তা-ও মালিক মেনে নেয়। কিন্তু অসুস্থ, সংক্রামিত ব্যক্তিকে দিয়ে কাজ করায় না। এখানে অসুস্থ লোকও খাবার বানায়।

Advertisement

তাপমাত্রা নিয়েও আমরা সতর্ক নই। ক্রেতারাও খেয়াল করেন না, ‘সার্ভিং টেম্পারেচর’ কী হওয়া দরকার। যথেষ্ট গরম (একশো চল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা ঠান্ডা (বিয়াল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম), এই দুইয়ের মাঝের যে তাপমাত্রা, তাকে বলে ‘ডেঞ্জার জোন।’ কারণ, এই তাপমাত্রাগুলোর মধ্যে জীবাণু সহজে জন্মায় ও বেড়ে ওঠে। তাপমাত্রা তার বেশি বা কম রাখলে জীবাণু নিষ্ক্রিয় থাকে, অর্থাৎ বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। তাই প্লেটের খাবার যথেষ্ট গরম বা ঠান্ডা কি না, তা খেয়াল রাখা দরকার।

পরিবেশনের সময়ে হাতের ব্যবহার এড়ানো চাই। খাবার চামচ বা চিমটে দিয়ে ধরতে হবে, নইলে গ্লাভস পরে ধরতে হবে। মিষ্টির দোকানে এই নিয়মটা প্রায়ই মানা হয় না। হাতে করে মিষ্টি তুলে দেওয়া হয় বাক্সে বা প্লেটে। এক অর্থে এ-ও উচ্ছিষ্ট খাওয়া, কারণ অনেকেরই আঙুলে নিজের মুখের লালা লেগে থাকে। বিশেষত ধূমপায়ীদের তো বটেই। অথচ চিমটে ব্যবহারে খরচ সামান্যই। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। হাতে করে মিষ্টি তুলতে দেখলে প্রতিবাদ করা উচিত ক্রেতাদেরও।

দোকান বা রেস্তোরাঁয় বাড়তি খাবার থেকে যাবেই। তার সংরক্ষণের পদ্ধতি আছে। গরম খাবারের তাপমাত্রা দ্রুত বিয়াল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নামিয়ে ফ্রিজে রাখতে হবে। পরে সেটুকুই বার করা দরকার যা তখনই পরিবেশন করা হবে। ফের গরম করতে হলে ১৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায় আনা দরকার। খাবারের তাপ মাপার থার্মোমিটার পাওয়া যায়। এর ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা দেখাটাও পরিদর্শনের সময়ে নজর করা জরুরি। উপকরণ খোলা পড়ে থাকলে মাছি, বাতাস-বাহিত জীবাণুতে সংক্রামিত হয়। তা-ও বন্ধ করা চাই।

রেস্তোরাঁ শিল্পে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পরিচ্ছন্নতার কয়েকটি বিষয় লোককে বোঝানো খুব কঠিন। যেমন, কাটিং বোর্ডে অন্য জিনিস না রাখার নিয়ম। প্রতিটি জিনিস কাটার জন্য আলাদা আলাদা কাটিং বোর্ড, ছুরি ব্যবহার করলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যাবে। তা সম্ভব না হলে প্রতিটি ব্যবহারের পর বোর্ড কলের জলে ধুতে হবে। যে রাঁধছে, তারও বারবার হাত ধোয়া খুব প্রয়োজন।

খাবারের প্লেট ধোয়া উচিত পাঁচটি ধাপে। গরম জলে, তার পর সাবান জলে, তার পর গরম বা ঠান্ডা জলে সাবানটা ধুয়ে ফেলা, শেষে তরল ক্লোরিন ঠিক মাত্রায় মেশানো জলে প্লেট আড়াআড়ি ধুয়ে ফেলা। বড় হোটেলগুলিতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে পরিষ্কার হয়। প্লেট সাফ রাখতে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে, নইলে কাগজের প্লেট দিতে হবে। ফুটপাথের দোকানে প্লেট-ধোয়া জলেই ফের নতুন প্লেট ধোয়া হয়। এ যে কত ক্ষতি করতে পারে, অনেকেই বোঝেন না।

খাবারের জন্য যে ক্ষতিগুলো হয়, তা শুধু ফুড পয়জনিং নয়। অনেক খাবারের বিষক্রিয়া অনেক পরে বোঝা যায়। অনেক সময়ে অসুস্থতার এত ধরনের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, যে খাবারের বিষক্রিয়াকে কারণ হিসেবে আলাদা করে নির্ণয় করা যায় না। অদৃশ্য থেকে খারাপ খাবার নিঃশব্দে শরীরকে ধ্বস্ত করতে থাকে।

কলকাতার একটি রেস্তোরাঁয় এগজিকিউটিভ শেফ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন