প্রবন্ধ১

ঠিক ঠিক অনুদানে আয়বৃদ্ধিও বাড়ে

শিল্পায়নে গরিবকে শামিল করতে গেলে তাকে শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ দিয়ে বাজারের উপযোগী করে তুলতে হবে। এই কাজে সরাসরি ভর্তুকির একটা বিরাট ভূমিকা আছে।সা ম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর কেউ কেউ বলছেন, গরিবকে স্রেফ ঘুষ দিয়েই নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুল ভোটে জিতে গেলেন। এর পিছনে উন্নয়নের কোনও গল্প নেই।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৬ ০০:০৫
Share:

সা ম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর কেউ কেউ বলছেন, গরিবকে স্রেফ ঘুষ দিয়েই নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুল ভোটে জিতে গেলেন। এর পিছনে উন্নয়নের কোনও গল্প নেই। এঁদের মতে, দু’টাকা কেজির চাল, কম দামের ওষুধ, সাইকেল, জুতো, কন্যাশ্রীর টাকা সবই আসলে ভর্তুকি— সরকারি টাকায় খয়রাতি— দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের নিরিখে নেহাতই বাজে খরচ।

Advertisement

বস্তুত, উন্নয়নের মানে এক এক শ্রেণির কাছে এক এক রকম। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত উন্নয়ন বলতে বোঝে শিল্পায়ন, যে শিল্পায়ন হলে তাদের ছেলেমেয়েরা ভাল চাকরিবাকরি পাবে। শিল্পায়নের প্রয়োজন নেই এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু গরিব মানুষ শিল্পায়ন নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয় এই কারণে যে, সে জানে আধুনিক শিল্পের উপযোগী শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ এই মুহূর্তে তার নেই, কাজেই শিল্পায়ন হলেও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে রাতারাতি তার অবস্থার উন্নতিও ঘটবে না। গরিব মানুষের কাছে উন্নতি মানে মোটা ভাতকাপড়, ন্যূনতম শিক্ষা, অসুখবিসুখ করলে কম খরচে চিকিৎসা। সরকারের কাছে তার চাহিদাও এটুকুই।

এই ন্যূনতম ভাত-কাপড়-শিক্ষা-স্বাস্থ্য যাঁরা চাইছেন তাঁদের একটা বড় অংশ গ্রামে থাকেন। ২০১১ সালে সারা দেশ জুড়ে যে আর্থ-সামাজিক সেন্সাস হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এই রকম মানুষের অনুপাত নেহাত কম নয়। দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাজ্যে ৭০% গ্রামের মানুষের নিজস্ব কোনও জমি নেই, যদিও সারা ভারতে এই অনুপাত ৪৩%। দেখা যাচ্ছে, পরিবারে যিনি সব থেকে বেশি রোজগার করেন তাঁর মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার কম এমন পরিবারের অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ৮২%, সারা ভারতের গ্রামে ৭৪%। এই সব পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে, সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল এই অসংখ্য গরিব মানুষগুলোর কথা ভেবে কাজ করা।

Advertisement

গত পাঁচ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঠিক এই কাজটাই করেছে। আধপেটা খেয়ে থাকা মানুষদের জন্য অল্প দামে চাল দিয়ে, গরিব ঘরের মেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দিয়ে, গ্রামে রাস্তাঘাট, বৈদ্যুতিকরণ, পানীয় জল জোগানের উন্নতি ঘটিয়ে, রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইশকুল-কলেজ বানিয়ে গরিব মানুষকে পরোক্ষ এবং অপরোক্ষ ভাবে সাহায্য করেছে। সেই কাজের প্রেক্ষিতে যদি সাধারণ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে, তা হলে তাকে গণতন্ত্রের এবং গরিব মানুষের জয়ই বলতে হবে। কিন্তু এই কাজের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কোনও বিরোধ আছে কি?

গ্রামে সড়ক-বিজলি-পানির উন্নতি ঘটানোকে কেউ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পরিপন্থী বলবেন না। প্রশ্ন, দু’টাকা কেজির চাল, কন্যাশ্রী, সাইকেল ইত্যাদি সরাসরি অনুদানগুলি নিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচকরা বলবেন, এই অনুদানগুলি গরিব মানুষের জীবনযাত্রার তাৎক্ষণিক উন্নতি ঘটাচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে দিন থেকে অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে, গরিব মানুষের জীবনযাত্রা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। অর্থাৎ ভর্তুকি দিয়ে জীবনযাত্রার মান বাড়ানোটা দারিদ্রের স্থায়ী সমাধান নয়। পক্ষান্তরে, যে টাকাটা ভর্তুকির পিছনে খরচ হচ্ছে সেটা যদি শিল্পের উন্নতির জন্য ব্যয় করা হত, তা হলে রাজ্যে অনেক কর্মসংস্থান হত, যার ফলে গরিব মানুষরাও আখেরে লাভবান হতেন।

এই সমালোচনা আপাতবিচারে গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যুক্তিগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁক আছে। প্রথমেই বলে নিই, গরিবকে বাদ দিয়ে যে উন্নয়ন তাকে আমরা উন্নয়ন বলব না। বস্তুত, গরিব মানুষের উন্নতিই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। শিল্পায়ন হলে গরিব মানুষ সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে উপকার পাবে, এই ধারণা ঠিক নয়। এটা ঠিক যে, শিল্প না এলে রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ঘটবে না। কিন্তু সেই শিল্পায়নে গরিব মানুষকে শামিল করতে গেলে তাকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-প্রশিক্ষণ দিয়ে বাজারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এই গড়ে তোলার কাজে সরাসরি ভর্তুকির একটা বিরাট ভূমিকা আছে।

সরাসরি খাদ্য অনুদান গরিব মানুষকে নিরাপত্তা দেয়। এই নিরাপত্তা থাকলে দরিদ্র মানুষ খানিকটা ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাজ করতে পারে। রেশনে খাদ্যোপযোগী দু’টাকা কেজির চাল না পাওয়া গেলে খাদ্য-নিরাপত্তা থাকত না। খাদ্য-নিরাপত্তা না থাকলে বাড়ির ছোট ছেলেটাকেও অল্প বয়স থেকে কাজে লেগে যেতে হত। ফলে তার আর লেখাপড়া হয়ে উঠত না। অন্য ভাবে বলতে গেলে, যে মানুষের জীবনে খাদ্য নিরাপত্তা নেই, যাকে প্রত্যেক দিন ভাবতে হয় কাল পেট চলবে কী করে, তাকে সব সময় বর্তমান নিয়েই ভাবতে হয়। ফলে ভবিষ্যতের জন্য সে নিজেকে বা নিজের সন্তানদের তৈরি করতে পারে না। খাদ্য নিরাপত্তা মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা কমিয়ে তাকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, এবং দরকার পড়লে খানিকটা ঝুঁকি নিতে, সাহায্য করে।

একই ভাবে মেয়েদের সাইকেল দিলে তাদের ইশকুলে যাওয়ার উৎসাহ বাড়ে। এর সঙ্গে আবার গ্রামের রাস্তা পাকা করারও সম্পর্ক আছে। আমাদের গ্রামের সনাতন কাঁচা রাস্তাগুলোতে বর্ষাকালে প্যাচপেচে কাদা, অন্য সময় একহাঁটু ধুলো। এই ধুলো-কাদা ঠেলে সময় মতো ইশকুলে পৌঁছনো সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে দূরের গ্রাম থেকে। গ্রামের রাস্তা পাকা করা হলে এবং একই সঙ্গে মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হলে সেই রাস্তা দিয়ে সাইকেলে চেপে সহজেই ইশকুলে পৌঁছনো সম্ভব হয়। বিহারে এই সাইকেল ও রাস্তার যুগলবন্দি মেয়েদের অনেক বেশি ইশকুলগামী করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও করবে না কেন?

গরিব ছেলেমেয়েদের পায়ে জুতো জোগাতে পারলেও তাদের ইশকুল যাত্রার কষ্ট লাঘব হয়। গ্রামের এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে খালি পায়ে হাঁটার যন্ত্রণা আছে। তা ছাড়া আছে বর্ষাকালে সাপখোপের ভয়। পায়ে একজোড়া জুতো থাকলে অনেকটা আরাম ও ভরসা পাওয়া যায়। এটা শুধু কথার কথা নয়। ঘানা, কেনিয়া, এল সালভাদর, এমনকী বড়লোক দেশ আমেরিকাতেও দেখা গেছে গরিব ছাত্রদের পায়ে জুতো পরাতে পারলে তাদের ইশকুল যাবার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।

কন্যাশ্রী প্রকল্পটি শুধু যে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে কিংবা তাদের কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে তা-ই নয়, তাদের আত্মপ্রত্যয়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই ধরনের প্রকল্প, যার পোশাকি নাম কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার বা শর্তসাপেক্ষ নগদ অনুদান, এখন পৃথিবী জুড়ে চলছে। আমাদের রাজ্যে প্রথম চালু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমস্ত প্রকল্প তাৎক্ষণিক ভাবে গরিব মানুষের জীবনযাত্রার মান অবশ্যই বাড়াচ্ছে, কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, তাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে সাহায্য করছে। একে যদি উন্নয়ন না বলি, তা হলে কাকে উন্নয়ন বলব?

এই মানবিক উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি আয়বৃদ্ধির গতিও বাড়াবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস সহ আরও অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন দীর্ঘমেয়াদি আয়বৃদ্ধি যেমন আর্থিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে, তেমনই নির্ভর করে মানবসম্পদের ওপরেও। গরিবরা সুযোগসুবিধে পেলে রাজ্যের মানবসম্পদ বাড়বে। প্রতিভা বা মেধা অবস্থাপন্নদের মধ্যে যেমন ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, গরিবদের মধ্যেও তেমনই। কিন্তু অবস্থার চাপে গরিব মেধাবীরা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রতিভার সুযোগ নিতে পারেন না। গরিবরা ভবিষ্যতের জন্য মুক্ত ভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারলে, তাঁদের মেধা, ক্ষমতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। মেধা ও প্রতিভার জোগান অনেক বাড়বে, আয়বৃদ্ধিও বেশি হবে।

সমালোচকরা প্রশ্ন তুলবেন, মানবসম্পদ না হয় বাড়ল, কিন্তু রাজ্যে আর্থিক বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? যেহেতু বিনিয়োগ আকর্ষণ নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে রেষারেষির অন্ত নেই, শিল্পপতিদের ঠিক মতো ভর্তুকি না দিলে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে আসবেন কেন? আর, সব টাকা যদি গরিবদের ভর্তুকি দিতেই চলে যায়, শিল্পপতিদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য কী পড়ে থাকবে?

করদাতার টাকায় ধনী শিল্পপতিদের ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে একটা নৈতিক আপত্তি থেকেই যায়। একে তো শিল্পপতি ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করছেন। তার ওপর সেই বিনিয়োগ থেকে সরাসরি যেটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে সেখানে গরিব, অ-প্রশিক্ষিত মানুষ আদৌ জায়গা পাচ্ছেন না। কিন্তু এর থেকেও দরকারি একটা কথা আছে। সিঙ্গুরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি গরিব মানুষের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিল্পায়ন সম্ভব নয়। গরিবের পেটে টান পড়লে সে রুখে দাঁড়ায়। তখন শিল্পায়নও হয় না, উন্নয়নও হয় না। তাই গরিবকে বাদ দিয়ে শিল্পায়ন শুধু যে নৈতিক ভাবে অসমর্থনীয় তাই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও তা পরিত্যাজ্য।

তা হলে কী ভাবে শিল্পায়ন হবে? আমাদের বিবেচনায়, ভর্তুকির প্রতিযোগিতায় না ঢুকে আমাদের রাজ্য যদি যথেষ্ট পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে, মোটের ওপর ব্যবসাবাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তা হলে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি দিন এই রাজ্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যে মূলত পরিকাঠামো তৈরি করার চেষ্টাটাই করছে। তা ছাড়া শ্রমের বাজারেও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। এখন আর আগের মতো কথায় কথায় ধর্মঘট হয় না, বন্‌ধ হয় না। দক্ষ শ্রমিকের অভাব তো পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিনই ছিল না।

পরিশেষে বলি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এ বারের নির্বাচনে যতটা বিপুল ভাবে ফিরে এসেছে, ২০০৬ সালে তার থেকেও বিপুল ভাবে ফিরেছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু সেই ফেরাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কারণ ২০০৬-এর পরবর্তী বছরগুলোতে বামফ্রন্ট গরিবদের উপেক্ষা করে, কিংবা বলা যায় তাদের ব্যবহার করে, শিল্পায়ন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, আর যাই হোক, গরিবদের কখনও উপেক্ষা করেনি। গরিবদের উপেক্ষা না করেও যে শিল্পায়ন সম্ভব সেটা হয়তো আগামী পাঁচ বছরে আমরা বুঝতে পারব।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন