সম্পাদকীয় ২

বেহুঁশ প্রচারক

অহিন্দু এবং অহিন্দুত্ববাদী, এই দুই শব্দের পার্থক্যই বুঝাইয়া দেয়, ঘটনাটা কী ঘটিতেছে। ভারতের ইতিহাসে এমন বহু কিছু আছে, মির্জা গালিবও— যাহা বাস্তবিক অহিন্দু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৭ ০০:৪৫
Share:

এ বার কোপের তলায় স্বয়ং গালিব। মির্জা গালিবের কবিতা-শায়েরি তাহার উর্দু ভাণ্ডার লইয়া হিন্দিকে খামকা ভারাক্রান্ত করিতেছে, ইহা ‘প্রকাশ্য’ যুক্তি। আর উর্দু ভাষার মধ্যে এবং উর্দু কবির মধ্যে শিক্ষাকর্তারা আদত ভারতীয়তা ক্ষুণ্ণ হইবার বিপদ দেখিতেছেন, ইহা হইল ‘প্রকৃত’ যুক্তি। সুকুমারমতি বালকবালিকারা উর্দুর চাপে হিন্দি পড়িতে চাহিতেছে না, ইহা হইল মিথ্যা প্রচার। আর, বিজেপি-শাসিত দেশে হিন্দি ভিন্ন অন্য ভাষা, বিশেষ করিয়া ইসলামি ছাপ-সংবলিত উর্দু ও পারসিক শব্দগুলি সংস্কারের সম্মার্জনীর ঘায়ে দূর করার প্রয়াস জোরদার চলিতেছে, ইহা হইল সত্য ঘটনা। বিজেপি এবং তাহার সাংস্কৃতিক অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ক্রমাগত প্রকাশ্যের তলায় প্রচ্ছন্নকে লুকাইতে চাহেন, মিথ্যা প্রচারে সত্যকে বিলকুল চাপিয়া দিতে চাহেন। গালিব কেন পাঠ্যক্রম হইতে বাদ দিতে হইবে, সেই হিন্দুত্ববাদী দাবির ক্ষেত্রেও তাঁহারা সেই খেলাই খেলিতেছেন। অনেক শিক্ষার রাজনীতি দেখিয়াছে এই দেশ, কিন্তু পাঠ্যক্রমের পদে পদে রাজনীতির শিক্ষাকে এই ভাবে প্রবিষ্ট করিবার চেষ্টা বেশি দেখে নাই। হিন্দুত্ব-ব্রিগেডের উদ্দেশ্য পরিষ্কার: ভুল করিয়াও যেন কোনও অহিন্দুত্ববাদী প্রভাব এ দেশে টিকিয়া না যায়!

Advertisement

অহিন্দু এবং অহিন্দুত্ববাদী, এই দুই শব্দের পার্থক্যই বুঝাইয়া দেয়, ঘটনাটা কী ঘটিতেছে। ভারতের ইতিহাসে এমন বহু কিছু আছে, মির্জা গালিবও— যাহা বাস্তবিক অহিন্দু। কিন্তু তাহার মানে এই নহে যে তাঁহাদের মধ্যে ভারতীয়ত্ব কিছু কম ছিল। গালিবের সাহিত্যরচনার তুঙ্গ সময়টি ভারতেই কাটিয়াছিল, ভারতেই তাঁহার সমঝদারেরা বাস করিতেন, ভারতেই তাঁহার মৃত্যু ও সমাধি ঘটিয়াছিল। যে ভাষায় গালিব শায়েরি লিখিয়া শ্রোতা-পাঠকদের অশ্রুধারা বহাইতেন, সেই ভাষাটিও দস্তুরমতো ভারতীয় ভাষা। উর্দুর জন্ম ও প্রসার ভারতেই, কিছু বিদেশি ভাষার সহিত দেশের কথিত ভাষার মিশেল। ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে নানা সংস্কৃতি মিশিয়াই এই মিশ্র ও মিষ্ট ভাষাটি জাত হয়। ভারতের বাহিরে ইহার গ্রহণযোগ্যতা কেবল পাকিস্তানেই, কিন্তু তাহাও এই জন্য যে ভারত-পাকিস্তান আসলে উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির যমজ সন্তান। এই সব সত্য দেশের নাগরিকদের অনেকেরই জানা। তাই আরএসএস-এর শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস-এর শীর্ষকর্তা দীননাথ বাটরার তত্ত্বাবধানে সেই সত্যকে এখন মিথ্যার স্তূপের তলায় গোর দিবার ব্যবস্থা চলিতেছে।

প্রসঙ্গত, যে দীননাথ বাটরা গালিবের ভারে ছেলেপিলেদের পিষ্ট হইবার দুর্নিয়তি রোধ করিতে ব্যস্ত হইতেছেন— মোদী ক্ষমতায় আসার পর তাঁহার উপরই শিক্ষার গৈরিকীকরণের মূল দায়িত্ব ন্যস্ত হইয়াছিল। আপাতত তিনি হিন্দুত্ববাদের হালটি ঠিক রাখিতে ন্যাস-এর পরিচালনা করেন। জানাতে চাহেন, ভারত কেবল হিন্দু নয়, হিন্দুত্ববাদী। সেখানে অন্য ধর্ম, সংস্কার, সংস্কৃতির পা ফেলিবার জায়গা নাই। গালিব তাঁহারা পড়েন নাই, তাই জানেন না যে, ধর্মের নেশা দেখে এই অসামান্য কবি লিখিয়াছিলেন, বেহুঁশ ধর্মপ্রচারীদের খুদা কী ভাবে হুঁশে ফেরান: ‘হোশ তব আয়া যব উসনে কহা কে খুদা কিসি এক কা নহি হোতা’। হিন্দুত্বের বেহুঁশ প্রচারকদের অবশ্য এই সার সত্য বোঝানোর কেহ নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন