ভাগ্যবিধাতা! জি-২০ বৈঠকে আলাপরত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জার্মানি, ৮ জুলাই ২০১৭। গেটি ইমেজেস।
হলিউডের বিখ্যাত কমেডিয়ান স্টিফেন কোলবা। আমেরিকার নানা রিয়ালিটি শো-তে তিনি এখনও মানুষকে মাত করে রাখেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব অস্বস্তিতে থাকেন এই মানুষটিকে নিয়ে। সেই স্টিফেন একটা নতুন শব্দ আমদানি করেছেন, ‘ট্রুথিনেস’ (truthiness)। যা সত্য নয়, অথচ মানুষ সত্য বলে মনে করছে। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ এক ধরনের মিথ্যা।
গোটা পৃথিবীতেই শাসক গণতন্ত্রের এ হেন truthiness তৈরি করে চলেছে। ট্রাম্প থেকে মোদী। বিষয়টা নিয়ে তো সবাই ভাবছি, ঠিক সে সময় হাতে এসে ঠেকল একটা বই। দীপঙ্কর সিংহের ‘দ্য ইনফরমেশন গেম ইন ডেমোক্রেসি’। দীপঙ্কর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক। দীর্ঘ দিন ধরে মিডিয়া তথ্য এবং সংযোগ, এই বিষয় নিয়ে তিনি লিখে চলেছেন। গবেষণা করে চলেছেন। রাউটলেজ আন্তর্জাতিক এডিশনের এই বইটি নিয়ে সারা বিশ্বের বিদ্বৎসমাজে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই বইটিতে লেখক বলছেন, এই সময়ে মিডিয়া পুঁজিবাদের একটা বিরাট প্রকোপ আমাদের রাজনৈতিক এবং সমাজ জীবনে এসে পড়েছে। মিডিয়া হয়ে উঠেছে এক প্রবল পরাক্রান্ত শক্তি। এই শক্তির ভাল প্রভাব যেমন আছে তেমনই খারাপ দিকও আছে। মিশরে টিউলিপ বিপ্লবে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল বিরাট। আবার মৌলবাদী শক্তিও সে বিপ্লবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল! প্রতিবিপ্লব আর বিপ্লব গুলিয়ে গিয়েছিল ফেসবুক বিপ্লবে। শাহবাগ আন্দোলনে মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল প্রগতিশীল শক্তি, আবার জামাতরাও মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের মতো করে সত্যকে উৎপাদন করেছিল।
প্রকৃত সত্যের চেয়েও বড় হয়ে উঠছে এই ‘মিডিয়াটাইজ়ড’ সত্য। এই গণতন্ত্রের নাম, ‘মিডিয়াটাইজ়ড’ গণতন্ত্র। এখানে রাজনৈতিক শক্তি তথ্যকে নিয়ে খেলছে। আগে বলা হত তথ্য সমাজ, এখন সেটাকে বলা হচ্ছে নেটওয়ার্ক সমাজ। সামাজিক রূপান্তরের আর একটা নতুন স্তর। এখন জনগণকে একটা নির্বাচিত অংশ পরিবেশন করা হবে। সেটা জেনে মানুষকে গণতন্ত্রে খুশি রাখার চেষ্টা হবে। স্টিফেন কোলবা একেই বলছেন ট্রুথিনেস! খবর খবর খেলা। এ এক ভয়ঙ্কর খেলা। এই খবরের খেলায় প্রত্যন্ত গ্রামে গরিব চাষিরা আত্মহত্যা করে না। সরকারি সাহায্যে খুশি। তারা ক্রমশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে।
ভূমিকাতেই দু’টি কার্টুনের কথা আছে। প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে একটি টিভি শো। বিতর্ক হচ্ছে। আগে থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, কী প্রশ্ন করা হবে। অর্থাৎ ‘প্রি-স্ক্রিন্ড’ প্রশ্ন! রাজনেতা বলছেন, আমার জবাবটাও ‘স্টক আনসার’। কিন্তু প্রতিপক্ষকে অস্ত্রহীন করে দেওয়ার জন্য আমি শুরুতেই রাখতে চাই ‘কেয়ারফুলি রিহার্সড জোক’।
ভাবুন! কোথায় জনগণ? কোথায় রাজনেতা? আর কোথায় টিভি মিডিয়া? কে কোথায় দাঁড়িয়ে? দ্বিতীয় পরিহাসটি হল, এক জন আমেরিকান সেনেটরের সচিব এসে তাঁর বসকে বলছেন, ‘‘আপনার বক্তৃতায় প্রায়ই যে আমেরিকার জনগণের কথা বলেন, তিনি এসেছেন। স্যর আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’’ অতএব, ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ এখন এই ‘মিডিয়াটাইজ়ড’ গণতন্ত্রের একটা চরিত্র মাত্র। ভিন্নতা বলে আসলে কিছু হয় না।
গোটা পৃথিবী জুড়ে এই আলোচনা শুরু হয়েছে। পোস্ট ট্রুথ, পোস্ট ফ্যাক্ট জমানা একেই বলা হচ্ছে। আমেরিকায় এই বিষয়ে প্রচুর বই লেখা শুরু হয়েছে ট্রাম্প জমানায়। বলা হচ্ছে গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে! আবার ট্রাম্প-ভক্তরা সম্প্রতি মিডিয়াতে পাল্টা প্রচার শুরু করেছেন, আমেরিকায় শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রেরই জয় হচ্ছে! ‘টাইম’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধ, আবার গণতন্ত্র বাঁচছে! ট্রাম্পের হাত ধরেই।
তবে এই উত্তর-সত্য যুগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন ভাবনা পেলাম জেরুজ়ালেম হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ইউভাল নোয়া হারারি–র সদ্য-প্রকাশিত বইতে। সেখানে তিনি বলেছেন মানুষ জন্মলাভ করার পর থেকেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে ভালবাসে। গোটা পৃথিবীর নানা দেশে নানা জাতীয় পুরাণের বহু আজগুবি গপ্পোকে যুগে যুগে সত্য বলে স্বীকার করেছে। হিটলার একটা মিথ্যাকে বার বার বলে সত্যে পরিণত করেছেন। সোভিয়েত রাশিয়া বা চিনের প্রোপাগান্ডা পোস্টার আর রঙিন ছবি দেখে মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এ হল গণপ্রজাতন্ত্রী চিন, বা এই সেই স্বপ্নের সোভিয়েত দেশ। শুধু ট্রাম্প পুতিন আর মোদীকে দোষ দিয়ে লাভ কী।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষে কত আত্মত্যাগ। কত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাংবিধানিক গণতন্ত্র। গাঁধী-নেহরুর বহুত্ববাদী দর্শন শত সমস্যার মধ্যে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যেও বেঁচে থেকেছে ভারতীয় সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি। ‘ডিসওবিডিয়েন্স’ মানেই যে নৈরাজ্য নয়, এই অন্ধ আনুগত্যবিরোধী স্বাধীন স্বকীয় ভাবনার অবাধ্যতা গণতন্ত্রেরই অঙ্গ। গাঁধীর দর্শন ও কর্ম সেটাই আমাদের শিখিয়েছে।
এ দিকে আজ দেখছি এক দিকে বাস্তবতা আর অন্য দিকে স্বপ্নময় বাস্তবতা। মিডিয়াটাইজ়ড ডেমোক্রেসি। ট্রুথিনেস। বনপ্রকল্পে কেন্দ্রীয় সাহায্যে গাছ বড় হচ্ছে। দূষণ রোধ হচ্ছে। গরিব মানুষ গ্রামে গ্রামে লেখাপড়া শিখছে। কম্পিউটার শিখছে। চাকরি পাচ্ছে। নিরন্ন কেউ নেই। সকলেরই রয়েছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। আধার কার্ড। চাষের মাঠে সার ইউরিয়া। ‘অচ্ছে দিন’ এসেছে, আসছে, আরও আসবে ২০১৯ সালের পর। এ হল ‘আকালের সন্ধানে’ ছবির চিত্রনাট্যের মতো। সিনেমার মধ্যে সিনেমা। খবর নিয়ে খেলা। আমরা আস্তে আস্তে বাস্তবতায় নয়, মায়া বাস্তবতার স্বপ্নে বাঁচতে শিখে গিয়েছি। জয় গণতন্ত্রের জয়!