পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর্ব শেষ। এক শত শতাংশ না হইলেও তৃণমূল কংগ্রেস গ্রামবাংলার অন্তত নব্বই শতাংশ দখল করিয়াছে। এই বিপুল জয়ের কতখানি মানুষের ভোটে, আর কতখানি অন্য পথে, সেই প্রশ্ন থাকিবেই। যে ভঙ্গিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন হইল, তাহাতে বিরোধীদের ক্ষোভ থাকাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট, এমন দাবি করিবার উপায় নাই। কিন্তু সেই ক্ষোভ, সেই অসন্তুষ্টি যদি অচলাবস্থা সৃষ্টি করে, যদি তাহা আরও হিংস্রতা, আরও সন্ত্রাস ডাকিয়া আনে, মারের পাল্টা মার চলিতে থাকে, তবে পশ্চিমবঙ্গের বিপদ। এই লগ্নে রাজ্যের মানুষ বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করাইয়া দিন যে তিনি জয়ী, কিন্তু নির্বাচনের ফলপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার দায়িত্ব ফুরাইয়া যায় না। বরং, সেই মুহূর্ত হইতেই দায়িত্বের সূচনা। রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কার্যত বিরোধীশূন্য হইয়াছে। বিরোধীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাহা শাসকের পক্ষে বিশেষ উপকারী। তাহারা শাসকের ভুলত্রুটি, অন্যায়-অবিচার চিহ্নিত করিয়া শাসককে সতর্ক করে, আত্মশুদ্ধির প্রণোদনা দেয়। সেই অর্থে তাহাদের ভূমিকা কিছুটা অভিভাবকের, অথবা হিতৈষী বান্ধবের। সেই ‘সুবিধা’ শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পাইবে না। ফলে, তাহাকে দ্বিগুণ দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইবার কোনও অবকাশ বিজয়ীর নাই।
দায়িত্বের দুইটি দিক। এক, উন্নয়ন নিশ্চিত করা। অনুব্রত মণ্ডলরা ‘উন্নয়ন’ শব্দটির যে কদর্থ করিয়াছেন, তাহাকে ভুলাইয়া দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম কর্তব্য। তৃণমূল স্তরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের ভূমিকা বিপুল। রাষ্ট্রের নিকট গ্রামীণ মানুষের যে পরিষেবাগুলি প্রাপ্য, তাহার একটি বড় অংশ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই পৌঁছায়। সে দিকে মন দিতে হইবে। অর্থনীতির গবেষণায় দেখা গিয়াছে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহিত উন্নয়নের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক রহিয়াছে। অর্থাৎ, যে পঞ্চায়েতে শাসক ও বিরোধীর রাজনৈতিক শক্তি তুলনীয়, সেখানে উন্নয়নও বেশি হয়। তত্ত্বটি যদি যথার্থ হয়, তবে কার্যত বিরোধীশূন্য পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের গতি হ্রাস পাইবার আশঙ্কা আছে। সেই আশঙ্কাটিকে অতিক্রম করিবার দায়িত্ব শাসক দলেরই। এবং, রাষ্ট্রীয় পরিষেবা পৌঁছাইয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন দলীয় রং বিচার না করা হয়, তাহা নিশ্চিত করাও মুখ্যমন্ত্রীরই কর্তব্য। নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকেই। ক্ষেত্রবিশেষে তাহা বৈর হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু নির্বাচন শেষ হইলে সেই তিক্ততার রেশ যাহাতে না থাকে, তাহা নিশ্চিত করিতে পারে বিজয়ী পক্ষই। আশা করা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথাটি ভুলিবেন না।
দায়িত্বের দ্বিতীয় প্রান্তে রহিয়াছে গণতন্ত্রের পরিসর। নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ভাবে জয়ী। কিন্তু, রাজ্যের সব মানুষ স্বভাবতই তাহাদের দিকে নহেন। কেহ আদর্শগত কারণে, কেহ অন্য তাগিদে বিরোধী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। তাঁহারা কোনও বাধার সম্মুখীন না হইয়াই সেই রাজনীতি করিতে পারিবেন, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করাও মুখ্যমন্ত্রীরই দায়িত্ব। স্পষ্টতই, এই নির্বাচনে বৃহত্তম বিরোধী শক্তি হিসাবে যে দলটির উত্থান হইয়াছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যের পক্ষে ইতিবাচক নহে। কিন্তু, সেই দলের সমর্থকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষাও মুখ্যমন্ত্রীরই দায়িত্ব। তিনি শুধু তৃণমূলের মহানেত্রী নহেন, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিটি নাগরিকের প্রতি সমদর্শী হওয়া তাঁহার কর্তব্য। রাজনৈতিক রং বিচার তাঁহার কাজ নহে। এবং, প্রশাসনও যাহাতে রং বিচারের অন্যায্য পথে না হাঁটে, তাহাও নিশ্চিত করিতে হইবে তাঁহাকেই। একটি রক্তক্ষয়ী নির্বাচন পার করিয়া পশ্চিমবঙ্গ এই বার শান্তিতে, সহনশীলতায়, সহাবস্থানে ফিরুক। মুখ্যমন্ত্রী রাজধর্মে স্থিত হউন।