এক অবিশ্বাস্যের আশায়
Coronavirus

ভ্যাকসিন তৈরির সময়কাল অতি দ্রুত কমিয়ে আনছে বিজ্ঞান

বছর ছয়েক আগে আফ্রিকার কিছু দেশে হঠাৎ করে ছড়ায় ইবোলা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ব্যাপারটাকে ‘ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করতে দেরি করেনি।

Advertisement

অর্ঘ্য মান্না

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২০ ০০:১৩
Share:

পরীক্ষা: কোভিড-১৯’এর ভ্যাকসিনের খোঁজে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান ট্রায়াল। ছবি: এপি

হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের চিকিৎসকেরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কী করা উচিত। চিকিৎসা করাতে ভর্তি হয়েছেন এক রোগিণী, ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করার সময় যিনি হাত কেটে ফেলেছেন। সে সময় তাঁর হাতে ছিল ইবোলা ভাইরাসের বোতল। সংক্রমণ দেহে ছড়িয়ে গিয়েছে কি না, তিনি নিজেও জানেন না। অবশেষে যোগাযোগ করা হল কানাডার এক গবেষণাগারে। শোনা গিয়েছিল, তাঁদের কাছে নাকি রয়েছে ভ্যাকসিন। সেটা ২০০৯ সালের মার্চ মাস।

Advertisement

বছর ছয়েক আগে আফ্রিকার কিছু দেশে হঠাৎ করে ছড়ায় ইবোলা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ব্যাপারটাকে ‘ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করতে দেরি করেনি। তবে ইবোলা মহামারি থেকে অতিমারি হয়ে ওঠার আগেই তা রুখে দেওয়া গিয়েছিল, কারণ এই ভাইরাসকে রোখার ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকেই। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জন জ্যাক রোজ় নিরীহ ভেসিকুলার স্টোমাটাইটিস ভাইরাস (ভিএসভি)-এর বাইরের প্রোটিনকে বিশেষ পদ্ধতিতে বাদ দিয়ে তার মধ্যে পুরে দিয়েছিলেন ইবোলার জেনেটিক মেটিরিয়াল। ফলে খাঁচাটি রইল ভিএসভি-র, কিন্তু জেনেটিক মেটিরিয়ালের কারণে বাইরের প্রোটিন হয়ে গেল ইবোলার। ব্যাপারটা অনেকটা কাকের গায়ে ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে দেওয়ার মতো! সেই বাইরের প্রোটিনকে আক্রমণ করার জন্য দেহে তৈরি হবে অ্যান্টিবডি, অথচ আসল খাঁচাটি নিরীহ হওয়ায় ভাইরাস দেহের মধ্যে বংশবিস্তার করতে পারবে না। জন জ্যাক রোজ়ের এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ভ্যাকসিন বানিয়েছিলেন কানাডার বিজ্ঞানী হেঞ্জ ফেল্ডম্যান ও তাঁর ছাত্র গ্যারি কোবিঙ্গার। তাঁদের তৈরি ভ্যাকসিন কোনও ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা পরীক্ষা করতে চায়নি, কারখানায় ব্যবসায়িক ভাবে তৈরিও করতে রাজি হয়নি। সবাই ভুলেও গিয়েছিল ব্যাপারটা। তার পরেই ২০০৯ সালে হামবুর্গের দুর্ঘটনা, এবং ২০১৪ সালে আফ্রিকায় ইবোলা মহামারি। বিস্মৃতির অতল থেকে জেগে উঠে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছিল ইবোলা ভ্যাকসিন।

বর্তমানে করোনা অতিমারি রোখার ভ্যাকসিনের সন্ধানের সঙ্গে ইবোলা ভ্যাকসিন তৈরির মিল দু’টি জায়গায়। প্রথমত, বিশ্ব জুড়ে একাধিক ল্যাবরেটরি নানা পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশা জাগিয়েছে ব্রিটেনের দু’টি দল— অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা গিলবার্ট পরিচালিত দল এবং ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের রবিন শাটক পরিচালিত দল। দুই দলই জন জ্যাক রোজ়ের পদ্ধতি অনুসরণ করছে। নিরীহ ভাইরাসকে কাক হিসেবে ব্যবহার করে ময়ূরপুচ্ছ হিসেবে লাগানো হচ্ছে করোনার স্পাইক প্রোটিন।

Advertisement

দ্বিতীয় মিল হল, ইবোলা সংক্রমণ রোখার মতোই বিজ্ঞানীদের করোনা ভ্যাকসিন তৈরি করতে হচ্ছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়, অতিমারির প্রকোপের মধ্যেই। ২০১৪ সালে গিনিতে যখন ইবোলা সংক্রমণ ছড়ায়, তখন এগিয়ে এসেছিলেন গ্যারি কোবিঙ্গার। তাঁর তৎপরতাতেই কানাডা সরকার হু-কে ভ্যাকসিন দেয় পরীক্ষা করার জন্য। নব্বইয়ের দশকে জন জ্যাক রোজ় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে ইবোলাকে রুখতে ভিএসভি-র খাঁচা তৈরি করেছিলেন, সেই ফর্মুলা তিনি দান করেছিলেন ১০০টি গবেষণাগারে। এই ভ্যাকসিন যে কাজ করে, তা পরীক্ষা হয়েছিল মাত্র এক বার— ২০০৯ সালে হামবুর্গের রোগিণীর উপর। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই হু ভ্যাকসিন পরীক্ষা শুরু করে সিয়েরা লিয়োন, লাইবেরিয়া ও গিনি-তে। মাত্র ১২ মাসের মধ্যে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় (ফেজ় থ্রি ট্রায়াল) উতরে যায় ভ্যাকসিন। ‘ল্যানসেট জার্নাল’-এর প্রধান সম্পাদক লেখেন, ‘‘অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক উত্তরণ।’’ অবিশ্বাস্য কেন? হু-এর ভ্যাকসিন প্রস্তুতির নিয়মাবলি সংক্রান্ত পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, ভ্যাকসিন প্রস্তুতির ন্যূনতম সময় ১০ থেকে ১৫ বছর। কেন এত সময়? ভ্যাকসিন প্রস্তুত ও প্রয়োগ করার আগে মোট সাতটি ধাপ রয়েছে। প্রথম দু’টি ধাপ হল এক্সপ্লোরেটরি স্টেজ ও ক্লিনিক্যাল স্টেজ। এই ধাপে ভ্যাকসিন সংক্রামক জীবাণুর কোন অংশকে (আসলে, প্রোটিন) আক্রমণ করবে তা খোঁজা হয়, এবং তা ইঁদুর, গিনিপিগ, বাঁদর বা শিম্পাঞ্জির উপর পরীক্ষা করা হয়। এই দু’টি ধাপে সফল হলে চলে পর পর তিনটি ধাপ: ফেজ় ওয়ান, টু এবং থ্রি ট্রায়াল। ফেজ় থ্রি ট্রায়ালের পর চলে লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া। এটিও অত্যন্ত জটিল, কারণ যে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে না। এর জন্য কোনও সরকারি বা বেসরকারি প্রস্তুতকারী সংস্থার সাহায্য প্রয়োজন হয়। সেই সংস্থা বিভিন্ন গুণমান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই মেলে লাইসেন্স। এর পরে চলে পোস্ট লাইসেন্সিং মনিটরিং ট্রায়াল— ফেজ় ফোর। ইবোলার ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের আগে প্রথম দু’টি ধাপের কাজ করাই ছিল। তিন ধাপের ট্রায়াল শেষ করা হয়েছিল মাত্র ১২ মাসে।

ভ্যাকসিন তৈরির ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যাবে, এক্সপ্লোরেটরি ও ক্লিনিক্যাল স্টেজ বুঝে উঠতেই সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রথম যে রোগকে মানুষ নির্মূল করতে পেরেছিল, তা হল স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে পৃথিবীকে গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করেছিল হু। কিন্তু বিজ্ঞানের এই উত্তরণ ঘটতে সময় লেগেছিল প্রায় ২৫০ বছর। গুটি বসন্ত সংক্রমণ ঠেকাতে ইমিউনাইজ়েশন পদ্ধতি চিন, ভারত ও তুরস্কে ভালই প্রচলিত ছিল। বসন্ত রোগের গুটির ভেতরকার তরলকেই ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হত। যদিও তখন ভ্যাকসিন শব্দটিরই জন্ম হয়নি। ভাইরাস কী, তা-ও অজানা ছিল। হারেমে মেয়েদের সৌন্দর্য যাতে গুটি বসন্তের সংক্রমণে নষ্ট না হয়ে যায়, তাই তুরস্কে ইমিউনাইজ়েশনের বহুল ব্যবহার দেখেছিলেন লেডি মেরি মন্টেগু। ১৭১৭ সালের ১ এপ্রিল সারা চিসওয়েলকে লেখা চিঠিতে প্রথম এই পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছিলেন মন্টেগু। তাঁর হাত ধরেই ইমিউনাইজ়েশন পদ্ধতির কথা জানে পাশ্চাত্য। ব্রিটেনে ফিরে তিনি ইমিউনাইজ়েশন প্রচলনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রায় ৮০ বছর পরে এই পদ্ধতিকেই জনপ্রিয় করে খ্যাত হন এডওয়ার্ড জেনার। এরও প্রায় দুই শতাব্দী পরে আধুনিক ভ্যাকসিন প্রয়োগে নির্মূল হয় গুটি বসন্ত।

গুটি বসন্তের মতোই প্লেগ রোগ নির্মূল করতেও লেগে গিয়েছিল বহু শতাব্দী। যে সমস্ত রোগ মহামারি ও অতিমারি হিসেবে মানব সভ্যতাকে মাঝেমধ্যেই বিপদে ফেলেছে, প্লেগ তাদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে। পুরনো মেডিক্যাল জার্নালই হোক কিংবা মহামারিকেন্দ্রিক উপন্যাস, প্লেগ ফিরে এসেছে বার বার। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আলেকজ়ান্দ্রা ইয়ারসিন প্রথম ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস জীবাণুকে প্লেগের জন্য দায়ী করেন, এবং ভ্যাকসিন তৈরি শুরু করেন। তা সত্ত্বেও বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগে পর্যন্ত বার বারই হানা দিয়েছে প্লেগ। ২০১৩ সালে ‘ফ্রন্টিয়ার্স অব ইমিউনোলজি’ প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই মিউটেশনের কারণে বদলে গিয়েছে প্লেগ-জীবাণু। তাই আরও উন্নত ভ্যাকসিন তৈরির কাজ এখনও চলছে।

গুটিবসন্ত বা প্লেগ, কোনও রোগই মহামারি বা অতিমারির আকার ধারণ করা অবস্থায় ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়নি। করোনা অতিমারির ১০২ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারির শিকার হয়েছিল বিশ্ব। তার ভ্যাকসিন বিষয়ক গবেষণা শুরুই হয়েছিল অতিমারি অতিক্রান্ত হওয়ার ২০ বছর পরে। এই তথ্যগুলিতে চোখ রাখলে বলাই যায় যে বিজ্ঞান গত এক শতকে দারুণ গতিতে উন্নতি করেছে। তাই সাধারণ ভাবে ভ্যাকসিন তৈরির ন্যূনতম সময়কাল এক দশক হলেও ইবোলাকে অতিমারি হওয়া থেকে আটকাতে ‘অবিশ্বাস্য’ কাণ্ড ঘটাতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। করোনা রুখতেও এমনই কোনও ‘অবিশ্বাস্য’-এর অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।

ইবোলা সংক্রমণ রোধের চেয়েও কাজটা এখন অনেকাংশে কঠিন। কারণ ইবোলাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল মহামারি পর্যায়ে। করোনা ইতিমধ্যেই অতিমারি। বিজ্ঞান এখন সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তবুও আশায় বুক বাঁধছে বিশ্ব, অবিশ্বাস্য কোনও কিছুর আশায়। তবে এখন যে দ্রুততায় ভ্যাকসিন তৈরির সময়কাল কমিয়ে এনেছেন বিজ্ঞানীরা, তাতে ফের এক বার লেখা হতেই পারে— ‘অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক উত্তরণ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন