মেঘলা বিকেল। এক কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে বাগানে সবে আয়েশ করে বসেছি, কলকাতা থেকে বন্ধুর ফোন— “শোন, দেশে এলে ভুলেও নিজেকে গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচয় দিবি না। লোকে তোদের ওপর হেব্বি খেপে আছে! একেবারে চাঁদা তুলে পেটাবে!”
ব্যাপারটা কী বুঝতে পারলাম না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন, কী হল হঠাৎ?
“দেখছিস না করোনা নিয়ে যারা গবেষণা করছে তারা কী সব ভুলভাল তথ্য দিচ্ছে! এক দল গবেষক বলেছিল মে মাসে করোনা বিদায় নেবে, এখন অবার অন্য দল বলছে অক্টোবর। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথাই ধর না! এত দিন ধরে বলে এল করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত রোগ নয়। আর এখন একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বলে কিনা বাতাসে ক্ষুদ্র কণার (ড্রপলেট) মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ছড়ালেও ছড়াতে পারে! এটা কি মামদোবাজি হচ্ছে? একই বিষয় নিয়ে সবাই গবেষণা করছে, অথচ এক জন সকালে যা বলছে, আর এক জন বিকেলে তার ঠিক উল্টো কথা বলছে! পাবলিককে বিভ্রান্ত করার একশো শতাংশ দায়িত্ব নিয়ে রেখেছিস নাকি রে তোরা?” বন্ধুর গলায় কপট রাগ।
বন্ধুর কথাগুলো যে অসত্য, তা মোটেই বলা যাবে না। সত্যিই তো, গত কয়েক মাসে করোনা নিয়ে নানা রকম তথ্য উঠে এসেছে গবেষণায়, যার কয়েকটি সম্পূর্ণত পরস্পরবিরোধী। করোনার প্রকোপ কমা বা করোনার বিদায় নিয়ে জনস্বাস্থ্য গবেষকরা নানা রকম মডেল ব্যবহার করে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন বিস্তর। দুঃখের বিষয়, তার প্রায় কোনওটাই মেলেনি। এটা অবশ্যই চিন্তার কথা, কারণ এর ফলে কেবল জনসাধারণ বিভ্রান্ত হচ্ছে তাই নয়, নীতি নির্ধারকরাও অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। কিন্তু ঠিক কেন কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে এত বিভ্রান্তি?
গবেষক হিসাবে মনে হয়, এর পিছনে দু’টি কারণ আছে। প্রথমত, যে কোনও ধরনের তথ্য-ভিত্তিক গবেষণাই যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। গবেষণায় প্রাথমিক ফলাফল অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া গেলেও, তার পর নানা উপায়ে সেই ফলাফল কতটা শক্তপোক্ত তা বিচার করার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে, যাকে গবেষণার পরিভাষায় ‘রোবাস্টনেস টেস্ট’ বলা হয়। কোনও গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল যদি এই রোবাস্টনেস টেস্টে না উতরোয়, তা হলে সেই ফলাফল কতটা ঠিক, সে বিষয়ে গভীর সংশয় জন্মায়। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বেশির ভাগ গবেষণাপত্রই রচিত হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত। গবেষকরা তাই তাঁদের গবেষণায় কতটা রোবাস্টনেস টেস্টের ব্যবহার করতে পারছেন, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ফলত, সেই সমস্ত গবেষণার ফলাফলসমূহ সত্যি সত্যি কতটা ঠিক, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা।
দ্বিতীয় কারণটা আরও উদ্বেগের। সমাজবিজ্ঞান বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চর্চায় যে কোনও গবেষণাই দাঁড়িয়ে থাকে একাধিক ‘অ্যাজ়াম্পশন’ বা অনুমানের ওপর। যেমন ধরা যাক, অর্থশাস্ত্রে যখন আমরা মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করি, আমরা সাধারণত ধরে নিই যে মানুষ যুক্তিবাদী এবং তাদের যা আয়, তারা সেটা ব্যবহার করে নিজেদের সন্তুষ্টি যতটা সম্ভব বৃদ্ধি করতে চায়— পরিভাষায় বললে, ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজ়েশন। এই ধরনের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গোটা গবেষণাটা হয় এবং গবেষণার ফলাফল পাওয়া যায়। কাজেই, গবেষণায় ব্যবহৃত অনুমানগুলি হওয়া উচিত একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবভিত্তিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বহু গবেষণাতেই ব্যবহৃত হয় এমন সমস্ত অনুমান, যা এই তিনটি মানদণ্ডের একটিও পূরণ করে না। এবং মজার কথা হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা গবেষকরা করে থাকেন একবারে জেনে বুঝে। তার কারণ সঠিক ভাবে গবেষণা করার পরিবর্তে, দুর্ভাগ্যবশত, গবেষকদের অনেক সময়ই লক্ষ্য হয় একেবারে সুনির্দিষ্ট, চাঞ্চল্যকর এবং তাক লাগিয়ে দেওয়া ফলাফল পাওয়া (যেমন করোনা বিদায় নেবে তেইশে শ্রাবণ ঠিক বিকেল চারটে বেজে তিন মিনিটে), যা অযৌক্তিক এবং অবিশ্বাস্য অনুমান ব্যবহার না করলে মিলতে নাও পারে। কোভিড-১৯’এর গবেষণাতেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভবত এটাই হয়েছে। এবং তাই এই বিভ্রান্তির অতিমারি।
বস্তুত, এই তাক লাগিয়ে দেওয়া ফলাফল পাওয়া এবং তার ভিত্তিতে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় বা সমাজমাধ্যমে নাম তোলার লোভে বহু গবেষকই যে প্রায়শই অযৌক্তিক এবং অবিশ্বাস্য অনুমান ব্যবহার করে থাকেন এবং তা করাটা যে একেবারেই অনুচিত, সেটা আজ বহু বছর যাবৎ বলে আসছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক চার্লস ম্যান্সকি-সহ বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানী। এঁদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার— অযৌক্তিক এবং অবিশ্বাস্য অনুমান ব্যবহার করার ফলে সুনির্দিষ্ট এবং চমকপ্রদ ফলাফল (বা ভবিষ্যদ্বাণী) পাওয়া যেতেই পারে, কিন্তু তা ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই ধরনের গবেষণার ফলাফল তাই নিশ্চয়তার এক রকম মিথ্যা ধারণা দেয়— অধ্যাপক ম্যান্সকির ভাষায়, ‘আ ফল্স সেন্স অব সার্টিটুউড’। এই পথে না হেঁটে গবেষকরা যদি বিশ্বাসযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবভিত্তিক অনুমানের ভিত্তিতে তাঁদের গবেষণা করেন, তা হলে সেই গবেষণার ফলাফলে হয়তো খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকবে, কিন্তু সেই ফলাফলে কোনও বিভ্রান্তি থাকবে না। জনসাধারণ বা নীতিনির্ধারকরা যখন সেই ফলাফলের বিষয়ে অবগত হবেন, সঙ্গের অনিশ্চয়তাটুকু সম্বন্ধেও তাঁরা ওয়াকিবহাল থাকবেন। ভ্রান্ত ফলাফলকে একশো শতাংশ নিশ্চিত বলে ভেবে বসে থাকার থেকে তা ঢের ভাল।
কোভিড-১৯’এর পরবর্তী সময়ে অনেক কিছুর প্রতিই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটবে বলে মনে হয়। গবেষকরাও গবেষণাপদ্ধতির প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাবেন কি?
নটিংহাম ইউনিভার্সিটি বিজ়নেস স্কুল, ইউ কে