কলঙ্ক

সংশয় নাই, ছাত্রসমাজের এই উচ্ছৃঙ্খলতাও কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতারই প্রতিফলন। কেবল কত জন দুষ্টস্বভাব ছাত্রছাত্রী একত্র হইয়া গোলমাল পাকাইতেছে, মন্ত্রী হইতে প্রাক্তনী অনেকের কণ্ঠেই এমন বিরাগ শোনা গেলেও তাহা সামগ্রিক সত্য হইতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২৩
Share:

নন্দনে প্রেসিডেন্সির সমাবর্তন অনুষ্ঠান। ফাইল ছবি

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে একটি কথাই বলিবার। প্রতি বার তাহা পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের অধঃপতনের নূতনতর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, প্রতি বার আগেকার দৃষ্টান্তটিকে ছাপাইয়া যায়। গত কয়েক দিন ধরিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে যে অসামান্য কুনাট্য ঘটিতেছে, তাহা দেখিয়া বঙ্গসমাজের বিধাত্রী দেবীকে ধরণী দ্বিধাবিভক্ত করিবার অনুরোধ জানানো ছাড়া কিছু করিবার নাই। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় তালা লাগাইয়া দিয়াছে, শিক্ষক করজোড়ে বাহিরে দাঁড়াইয়া প্রবেশ করিবার অনুমতি প্রার্থনা করিতেছেন, এবং সহর্ষে প্রত্যাখ্যাত হইতেছেন, এই ছবি দেখিয়া বাঙালি হিসাবে লজ্জায় আত্মগোপন করা ছাড়া উপায় কী। ছাত্রদের দাপটে সমাবর্তন অনুষ্ঠানও এ বার ভিন্ন জায়গায় সরাইতে হইল। প্রত্যক্ষ ভাবে সমাবর্তনে তাহারা বাধা দেয় নাই ঠিকই, কিন্তু বাধা তো কেবল এক রকম নহে। এমন অস্বাভাবিক অসহযোগিতাময় পরিস্থিতিতে সমাবর্তনের মতো অনুষ্ঠান করা কঠিন তো হইবেই। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে পার্থক্য করিতেও যাহারা অসমর্থ— এক কালের ঐতিহ্য-সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠরত আজিকার সেই দুরাচারী ছাত্রসমাজ রাজ্যের কলঙ্ক। ভাবিতে শিহরন হয়, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ইহাদের তৈরি করিয়াছে এবং ইহারা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ তৈরি করিবে।

Advertisement

সংশয় নাই, ছাত্রসমাজের এই উচ্ছৃঙ্খলতাও কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতারই প্রতিফলন। কেবল কত জন দুষ্টস্বভাব ছাত্রছাত্রী একত্র হইয়া গোলমাল পাকাইতেছে, মন্ত্রী হইতে প্রাক্তনী অনেকের কণ্ঠেই এমন বিরাগ শোনা গেলেও তাহা সামগ্রিক সত্য হইতে পারে না। সত্যের বাকি অংশটি নিহিত রহিয়াছে কর্তৃপক্ষের কদাচরণের মধ্যে। ছাত্রাবাস এখনই চাই, এই দাবি অন্যায্য হইতে পারে। কিন্তু ছাত্রাবাস এত দিনে তৈরি না করিতে পারাও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার লক্ষণ। সাকুল্যে তিন হইতে পাঁচ বৎসর যে ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটায়, এতখানি সরকারি গাফিলতি বা ঢিলাঢালার দাম তো তাহাদেরই চুকাইতে হয়। একান্ত কোনও অসুবিধায় ছাত্রাবাস নির্মাণ শেষ না হইলে দূরের ছাত্রাবাস হইতে তাহাদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাটিও কর্তৃপক্ষকে করিতে হইবে। পুরা বিষয়টির মধ্যে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার ইঙ্গিত প্রতি স্তরে। প্রশাসন তাই কোনও ভাবেই দায় এড়াইতে পারে না। কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়— রাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রসমাজ ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে এতখানি পারস্পরিক অনাস্থা কি নেহাত কাকতালীয়? না। ইহাতে একটি সামগ্রিক অবক্ষয়ের ছবি। সেই অবক্ষয়ের এক দিকে তরুণসমাজের ধৃষ্টতা থাকিলে অন্য দিকে আছে প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা।

প্রসঙ্গত, এই সেই প্রতিষ্ঠান যাহাকে বিশ্ববিদ্যালয় মর্যাদায় ভূষিত করিতে বঙ্গীয় প্রশাসন আদাজল খাইয়া লাগিয়াছিল। এই সেই প্রতিষ্ঠান যাহার দ্বিশতবার্ষিকী পালনে অভাব-জর্জরিত রাজ্যে কল্পনাতীত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হইয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী কয়েক মাস আগে সদম্ভে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করিয়াছিলেন, এমন সব প্রতিষ্ঠান থাকিতে রাজ্য ছাড়িয়া কেন তাহারা অন্যত্র পড়াশোনা করিতে যাইতে চাহে। প্রেসিডেন্সির সাম্প্রতিক সঙ্কটের ছবিগুলি তাঁহাকে পাঠাইয়া বলিতে ইচ্ছা হয়: তাঁহার প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই বুঝিয়া লউন। যে তীব্র কঠিন রোগে এই রাজ্যের শিক্ষাভুবন আক্রান্ত, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় সেই রোগাক্রান্ত রাজ্যের অনন্য বিজ্ঞাপন। গোটা দেশে— কেবল দেশে কেন, সমগ্র পৃথিবীতে ইহার নূতন খ্যাতি ছড়াইয়া পড়ুক। শিক্ষা হইতে প্রশাসন, বাঙালির সর্বব্যাপী অসুস্থতা বিশ্বজনগোচর হউক। তৃণমূল সরকার প্রচারিত ‘বিশ্ব-বাংলা’ শব্দদ্বয়ও তখন নূতন আলোকে উদ্ভাসিত হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন