শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসের মাহাত্ম্য শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি

শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করে শিশুশ্রম আটকানো যায় না। দরকার প্রতি পরিবারের আর্থিক উন্নতি। লিখছেন বিদ্যুৎ রাজগুরু উৎপাদনের বিপজ্জনক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকদের ব্যবহার করা হয় আকছার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৯ ০৫:৩৪
Share:

২০০২ সালের ১২ জুন থেকে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম সংস্থা (আইএলও) বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে আসছে। আজ সেই দিন। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘চিল্ড্রেন শুড নট ওয়ার্ক ইন ফিল্ডস, বাট অন ড্রিমস’। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ বছরও পালন করা হবে এই বিশেষ দিবস। একই সঙ্গে অশ্রুত থাকবে না সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের অসহায় শিশুদের চাপা কান্না, নির্যাতন, নিপীড়ন আর অত্যাচারের করুণ কাহিনি।

Advertisement

উৎপাদনের বিপজ্জনক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকদের ব্যবহার করা হয় আকছার। শুধু তাই নয়, অসামাজিক কাজে সুকৌশলে ব্যবহৃত হচ্ছে সহজ সরল শিশুমন। সীমান্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে দুনিয়ার সব চোরাকারবারি বা নেশাদ্রব্য পাচারকারীরা সামাজিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে পণ্যের মতো শিশুপাচার চক্র সক্রিয় রাখছে। এ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুদের অবস্থা আরও শোচনীয়। গৃহকাজে ‘কাজের মেয়ে’ নামে যখন পরিচিতি ঘটে তাদের, সর্বনাশের বাজনা তখনই বেজে যায়। ন্যূনতম মজুরিতে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় এই শিশুদের। চুক্তির মধ্যে দিয়ে প্রায় ক্রীতদাসের জীবন কাটাতে হয়। দারিদ্র ভারতের অভিশাপ। এক দিকে প্রাচুর্যের প্রহেলিককা, অন্য দিকে দারিদ্রের হাহাকার। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা কিংবা স্রেফ দারিদ্রের কারণে কঠিন কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয় শিশুদের। দেশের দলিত, আদিবাসী জাতিধর্ম নির্বিশেষে দারিদ্র যেখানে চরম, সেখানেই কর্কট রোগের মতো শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে।

দরিদ্রপীড়িত বাবামায়েরা অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছেন। উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করছেন তাঁরা। মাঝপথে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ‘স্কুলছুট’ হয়ে যাচ্ছে। অভাবেই। যাদের ঠাঁই হচ্ছে শিশুশ্রমিক রূপে, নির্মাণকাজ-সহ বিভিন্ন অসংগঠিত শিল্পে। এর জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক কারণই দায়ী। তবুও আমরা ভাবের ঘরে চুরি করি, উলঙ্গ সত্যকে তুলে ধরি না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোভী স্বার্থান্ধ মানুষ শ্রমবৃত্তিতে বেপরোয়া ভাবে শিশুশ্রমিকদের নিয়োগ করছে। এ লজ্জা রাখব কোথায়? সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। প্রাকৃতিক বির্পযয়, উদ্বাস্তু সমস্যা, দম্পতির একাধিক সন্তান— এ সমস্ত কারণ যেমন রয়েছে, তেমনই নগরায়ণের ফলে দারিদ্রপীড়িত মানুষ কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। বস্তিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। অন্ধকার জগৎ শিশুদের লোভ দেখিয়ে চুরি-ছিনতাইয়ের কাজে লাগাচ্ছে। শিশু অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। লালসায় মত্ত কিছু মানুষ দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে সহায়সম্বলহীন শিশুদের দুর্বিষহ জীবনের পথে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা বা দেশের শ্রম আইনের বিন্দুবিসর্গ তারা জানে না, জানতে পারছে না।

Advertisement

বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা সমস্যা নিরসনে কাজকর্ম করছে ঠিকই, তবে শিক্ষার প্রসার আর সচেতনতা বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে আশু প্রয়োজন। কিন্তু ‘চারিদিকে আলো জ্বলে অন্ধকার ঘোচে না তথাপি’। শিশুদের উপর চলে নৃশংস অত্যাচার। কন্যা শিশুদের উপর যৌন লাঞ্ছনা রোজকার খবর। রক্ষককে দেখা যায় ভক্ষকের ভূমিকায়। প্রায়ান্ধকার কুঠিতে আর আবাসনে শিশুর কান্নার নোনা জলে ভেসে যায় সভ্যতার অহঙ্কার।

বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা। বারুদের কারখানায় আতসবাজি তৈরি থেকে শুরু করে ইটভাটা, পাথরখাদান, কারুশিল্প, রাসায়নিক কারখানায়, হোটেল-রেস্তোঁরায় বয়ের কাজে তাদের দেখা যায়। কয়লা খাদান বা কয়লা পাচারের কাজে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে দারিদ্রপীড়িত শিশুরাই। মাফিয়া চক্রের এক প্রকার মুশকিল আসান যেন এরা। ভিক্ষাবৃত্তির কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে এদের। গৃহকাজ, অটোমোবাইলের গ্যারেজ, বিড়ি তৈরি, জঙ্গলমহলে পাতার থালা তৈরি, আর্বজনা ঘেঁটে কাগজ কুড়ানো, চায়ের দোকানে শ্রমিক হিসেবে এদের কাজে লাগানো হচ্ছে। রেলস্টেশন-সহ বিভিন্ন স্থানে পথ শিশুদের দেখা যাচ্ছে। শ্রম আইনে বলা রয়েছে, শিশুদের ১৮টি নির্দিষ্ট পেশায় এবং ৬৫ ধরনের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। আমাদের দেশে আইন লঙ্ঘন করে কোনও ব্যক্তি কোনও শিশুকে নিয়োগ করলে তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত কারাবাস অথবা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

দেশে শিক্ষার অধিকার আইনে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের বিনামূল্যে এবং আবশ্যিক ভাবে স্কুলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। মিড-ডে মিল আর বিভিন্ন ভাতার সুযোগ-সুবিধারও আশ্বাস রয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নীতি অনুসারে শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত শিশুদের পুনর্বাসনে নজর দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করা এবং তাদের বিশেষ স্কুলে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। কিন্তু শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে সমাধান সম্ভব নয়। শিশুদের বিশেষ বিদ্যালয়ে পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থার উন্নতিও দরকার।

শিশুরা বাঁচুক স্বপ্ন নিয়ে। সব শিশু সুযোগ পাক পড়াশোনার। সব শিশুর অধিকার সুনিশ্চিত হোক। একটি দেশের যোগ্য জনসংখ্যাই সংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে পারে। সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে পারে। তা না হলে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস প্রবিবার আসবে-যাবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না!

(লেখক ফাঁসিদেওয়া নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন