শিক্ষায়তনে দুরাচারের অভিযোগ জানানোর ঠিক উপায়টা কী

ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে

সারস্বত চর্চার বৃত্তে স্বজনপোষণের রেওয়াজের দিকেই পরোক্ষে আঙুল তুলেছিলেন আশিস। আজ এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে কথাগুলো নতুন করে মনে পড়ছে। গত কয়েক দিনে এ দেশের উচ্চশিক্ষা মহল যে তোলপাড় হয়ে গেল, তাতে এই আত্মানুসন্ধান প্রয়োজন মনে হয়।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১৬
Share:

বছর কয়েক আগে জয়পুর সাহিত্য উৎসবে দুর্নীতি ও জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে একটি বক্তৃতা দিয়ে বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন সমাজবিদ আশিস নন্দী। সেখানে অনেক কথার মধ্যে তাঁর একটা কথা ছিল, যার নির্যাস অনেকটা এই রকম— আমি আপনি যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হই, তা হলে আমি আপনার ছেলেকে হার্ভার্ডে স্কলারশিপ পাইয়ে দেব, আপনি আমার মেয়েকে অক্সফোর্ডে পাঠাবেন। ব্যাপারটা দুর্নীতির মতো দেখতেই লাগবে না, মনে হবে প্রতিভার সমাদর মাত্র!

Advertisement

সারস্বত চর্চার বৃত্তে স্বজনপোষণের রেওয়াজের দিকেই পরোক্ষে আঙুল তুলেছিলেন আশিস। আজ এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে কথাগুলো নতুন করে মনে পড়ছে। গত কয়েক দিনে এ দেশের উচ্চশিক্ষা মহল যে তোলপাড় হয়ে গেল, তাতে এই আত্মানুসন্ধান প্রয়োজন মনে হয়। এবং স্বজনপোষণের নির্দিষ্টতার বাইরেও অ্যাকাডেমিয়াতে তার দৈনন্দিনতার নিজস্ব গড়নেই কত রকম ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তির বলয় তৈরি হয়, সেটা চিহ্নিত করার সময় এসেছে। আর পাঁচটা পেশার মতোই অ্যাকাডেমিয়াতেও ঊর্ধ্বতনের নেকনজরে থাকতে পারার তাগিদটি যে কত ‘জরুরি’, তা কবুল করা দরকার হয়ে পড়েছে।

সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে ঘটনা পরম্পরাটি একটু বলে রাখা যাক। সম্প্রতি হলিউডের অত্যন্ত নামজাদা প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টেইনকে তাঁর নিজের সংস্থা থেকে সরে যেতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। সে সব খতিয়ে দেখেই এই পদক্ষেপ। প্যান্ডোরার বাক্সটা খুলে গিয়েছে তার পরেই। হার্ভির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন একের পর এক অভিনেত্রী, মডেল, অফিস কর্মী... কে নেই সেই মিছিলে! এবং হার্ভিকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও ব্যাপারটা অচিরেই বিশ্বব্যাপী এক কোরাসে পরিণত হয়! ‘মি টু’ লিখে কোটি কোটি মেয়ে, সঙ্গে বহু পুরুষও, জানাতে থাকেন: লাঞ্ছনার শিকার আমরাও! কেউ বাড়িতে, কেউ রাস্তায়, কেউ ট্রেনে-বাসে, কেউ শিক্ষায়তনে, কেউ কর্মক্ষেত্রে, কেউ ধর্মস্থানে...

Advertisement

এরই মধ্যে ঘটে গেল আরও কিছু, পর পর। নিউ ইয়র্ক শহরের মহিলা সাংবাদিক মহল থেকে সংবাদজগতের মধ্যে বেশ কিছু ‘নিগ্রহকারী’র নাম লিখে একটা তালিকা পেশ করা হল। আর এক মার্কিন মহিলা সবিস্তার লিখলেন জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর হেনস্তা হওয়ার অভিজ্ঞতা। সেখানেও কিছু নাম এল। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক আইনের ছাত্রী তার পরেই ফেসবুকে তুলে দিলেন আরও একটি তালিকা, যেখানে এ দেশের নামীদামি-পরিচিত-স্বল্প পরিচিত শিক্ষক-গবেষকদের নাম রয়েছে। ওই ছাত্রীর দাবি, তিনি ও তাঁর কিছু সহযোগীর কাছে ওই তালিকাভুক্তদের নামে যৌন হেনস্তার অভিযোগ জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহু মেয়ে। কী অভিযোগ, কবেকার অভিযোগ, কাদের অভিযোগ, সে সব কিছুই তালিকায় নেই। আছে শুধু ‘অভিযুক্ত’দের নাম। ওই ছাত্রীর দাবি, অভিযোগকারিণীরা অন্য রক্ষাকবচ না পেয়েই এ পথ নিয়েছেন।

এই তালিকাকে ঘিরে সারস্বত চর্চার মহলটি এক ঝটকায় প্রায় দু’ভাগে বিভক্ত। একটি অবস্থান মনে করছে, দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এ ভাবেই তার আত্মপ্রকাশের রাস্তা খুঁজে নিয়েছে। কাজটা যতই আপত্তিকর হোক, কেন ঘটনাটা এই রকম আকার নিল, বোঝা দরকার। অন্য এক অবস্থান হল, এবং দেশের প্রথম সারির নারীবাদীরা সেটা বিবৃতি দিয়েই বলছেন যে, কোনও রকম তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এই ভাবে নাম টাঙানো কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কারও যদি অভিযোগ থেকে থাকে তাঁর বা তাঁদের উচিত, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সেই অভিযোগ নথিভুক্ত করা। তালিকা-প্রণেতারা অবশ্য সে পরামর্শ শোনেননি। বরং অপছন্দের সুর কানে এলেই ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পিতৃতন্ত্রের চক্রান্ত আবিষ্কার করে ফুঁসে উঠছেন এবং জাতপাতের প্রসঙ্গ টেনে এনে বিষয়টি যথেষ্ট গুলিয়েও দিয়েছেন।

আবার উল্টো দিকেও একটা কথা মনে না রাখলেই নয়। তালিকা-প্রণেতাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় যাইই হোক না কেন, এ নিয়ে আলোচনার পরিসরটি কিন্তু তাঁদের কুক্ষিগত নেই আর। সুতরাং কোন বাস্তবতা থেকে এমন একটি তালিকার জন্ম হয়, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার বলে যাঁরা মনে করছেন, তাঁদের সকলকে তালিকা-পন্থী বা তালিকা-প্রণেতাদের মুখপাত্র বলে ধরে নেওয়ার কারণ নেই। এই তালিকা কতটা খাঁটি, কতটা ভিত্তিহীন, সেটাও পৃথক সন্ধানের বিষয় হতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে নৈতিক অবস্থানের প্রশ্নটি তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি নয়।

কর্মক্ষেত্রে, বিদ্যায়তনে যৌন হেনস্তা প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপযুক্ত ব্যবস্থা যে আজও গড়ে ওঠেনি, সে কথা সকলেরই জানা। কী করে তা গড়ে তোলা যায়, যেটুকু গড়ে উঠেছে কী করে তাকে সক্রিয় রাখা যায়, যেটুকু সক্রিয় আছে কী করে তা ত্রুটিমুক্ত করা যায়, সেই লড়াইও জারি আছে। কিন্তু এই তালিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, প্রয়োজনের তুলনায় তা কতখানি অপর্যাপ্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়িত্বরহিত ফর্দ ঝোলানো সমর্থনযোগ্য নয়। প্রশ্ন নেই এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে উৎসাহ দেওয়ারও। চুনি কোটালের আত্মহত্যা ঘিরে যা যা ঘটানো হয়েছিল, অনেকেরই স্মৃতিতে তা আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি তার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা এমনিতেই বহুগুণ বাড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু একই সঙ্গে বলব, এই তালিকা-কাণ্ড প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদের লড়াইকে পিছিয়ে দিল বলে শুধু ক্রুদ্ধ বা ক্ষুণ্ণ না হয়ে আত্মসমীক্ষণেও অধিকতর মনোযোগ দাবি করে বোধহয়।

উচ্চশিক্ষার জগতে শিক্ষক ও পড়ুয়ার সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতার বহুমূলী বিন্যাসটি খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এক জন পড়ুয়া বা শিক্ষানবিশ গবেষক কেন সচরাচর অভিযোগ জানাতে অপারগ এবং নির্দিষ্ট অভিযোগ-সেল তার কাজটা ভাল ভাবে করলেই কেন এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। ‘প্রভাবশালী’রা শুধু রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণ করেন না, অনেক পেশার মতোই উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রটিও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয় পারস্পরিক নেকনজর ও সুসম্পর্কের সমীকরণে। সেখানে বেশির ভাগই বেশির ভাগের পরিচিত, ঘনিষ্ঠ। হয় পারিবারিক নয় পেশাগত বন্ধুতায় আবদ্ধ। একে অপরের পৃষ্ঠপোষক। এ অবস্থায় কার কাছে কার বিরুদ্ধে মুখ খুলবে কোনও পড়ুয়া? ‘ওকে অনেক দিন চিনি, ও এ রকম করতেই পারে না’, ‘আগে তো কখনও শুনিনি’, ‘কই আমার সঙ্গে তো হয়নি’, ‘আমি যাদের চিনি, তাদের কেউ তো কখনও বলেনি’, ইত্যাকার বাক্যের পাহাড় ডিঙিয়ে, বা কপাল ভাল হলে না ডিঙিয়েই, ধরা যাক কেউ অভিযোগ পেশ করল! তার পর? অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাঁর বিশাল পরিচিত-গোষ্ঠী তো অভিযোগকারীর প্রতি চিরতরে চটবেন! এত শত্রু তৈরি করে অভিযোগকারী তার কেরিয়ার নিয়ে এগোতে পারবে কি? আশঙ্কা যদি বরাতজোরে ভুল প্রমাণও হয়, মনে রাখতে হবে, ভুল মানেই কিন্তু অমূলক নয়! বাস্তবে ক্ষতি হচ্ছে কি না-র চেয়েও বড় হল, ক্ষতি হতে পারে, এই ভীতি। যা তৈরি করে ক্ষমতা। শিক্ষক চান বা না চান, এই ক্ষমতা তাঁর করায়ত্ত। পরীক্ষার খাতা থেকে গবেষণাপত্র, নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্র থেকে স্কলারশিপের শিকে, সেমিনারে আমন্ত্রণ থেকে চাকরিপ্রাপ্তি ও পদোন্নতি— প্রতিটি ধাপে ‘রেকো-সংস্কৃতি’র প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বৈতরণী যেখানে পার হতে হয়, সেখানে ক্ষমতাকে ভয় না পেলে চলে?

এ সব কথা বলার অর্থ কখনওই এ নয়, অগণিত শিক্ষক-অধ্যাপক-গবেষক যাঁরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁরা সকলে কোনও না কোনও ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অন্যায় সুবিধাভোগী। কিন্তু সুসম্পর্কের নেটওয়ার্ক এবং তার গুরুত্বটি আশা করি তাঁরা মানবেন। সম্ভাব্যতার নিরিখে এও মানবেন, ভাল ডাক্তার, ভাল উকিল, ভাল গাইয়ে যেমন যৌন অপরাধী হতে পারেন, ভাল শিক্ষক-ভাল পণ্ডিতও পারেন। নিজে নারীবাদের মার্গদর্শক হলেও পারেন। এটা মানতে শেখা মানে ‘তালিকা’কে মান্যতা দেওয়া নয়, বরং নারী আন্দোলন রূপকার্থে আজ যে চৌরিচৌরায় উপনীত, তা থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন