শ্রী অশোক মিত্র (১৯২৮-২০১৮)

আবার তার অনেক আগের ঘটনা। ১৯৮৬ সালে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে সেই যে সরে গিয়েছেন তিনি, আর নির্বাচনের ময়দানে ফেরেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৮ ০১:০০
Share:

কলম তাঁর বরাবরই ধারালো। সেই কলম থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রে নিয়মিত তীক্ষ্ণ সমালোচনা আসছে বামফ্রন্ট সরকারকে বিদ্ধ করে। এই বাতাবরণেই শহরের রাস্তায় বিশিষ্ট জনেদের ছবি সংবলিত হোর্ডিং পড়ল। ‘পরিবর্তন চাই’। আর্জি গেল তাঁর কাছেও। পণ্ডিত মানুষ, এমন ক্ষুরধার সমালোচক। তিনি যদি কোনও বিবৃতিতে সই করে দিতে রাজি হন। কিন্তু না। রাজি হলেন না তিনি।

Advertisement

আবার তার অনেক আগের ঘটনা। ১৯৮৬ সালে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে সেই যে সরে গিয়েছেন তিনি, আর নির্বাচনের ময়দানে ফেরেননি। যদিও যে নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটাই মেরামত হয়েছে। বিধানসভা আর লোকসভায় একসঙ্গে ভোট হবে সে বার। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার জন্য ওজনদার ব্যক্তিত্বের খোঁজ চলছে। সত্তরের ‘কালো দিন’-এর টক্কর নিতে নিজেই এগিয়ে এলেন তিনি। প্রার্থী হয়ে গেলেন চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে।

অশোক মিত্র এমনই। আজীবন। নিজের আদর্শ, নিজের নীতি, নিজের বিশ্বাসে অবিচল। যে কোনও পরিস্থিতিতে।

Advertisement

অবিভক্ত বাংলায় জন্ম ১৯২৮ সালে। অর্থনীতিতে স্নাতক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশভাগের ধাক্কায় ও’পার থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা শুরু। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি শেষ পর্যন্ত না পেয়ে বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেন। গিয়েছিলেন দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ। তার পর নেদারল্যান্ডসে গবেষণা। রটারডাম থেকে পিএইচ ডি, গবেষণা করেছিলেন অর্থনীতিতে প্রথম নোবেলজয়ী ইয়ান টিনবার্জেন-এর কাছে। আইআইএম ক্যালকাটা-সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। তবে মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ হিসেবেই অশোকবাবুর পরিচয়।

সেটা অবশ্য খণ্ড-পরিচয়। অর্থনীতি ও রাজনীতি চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের বৃহত্তর ভুবনে সারা জীবন তাঁর স্বচ্ছন্দ এবং সৃষ্টিশীল পদচারণা। সংবাদপত্রে ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম, অন্যান্য প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা— অজস্র লেখা লিখেছেন বাংলায় ও ইংরেজিতে। ক্যালকাটা ডায়রি, হুডলাম ইয়ার্স, ফ্রম দ্য র‌্যামপার্টস থেকে তাল বেতাল, কবিতা থেকে মিছিলে, সমাজ-সংস্থা-আশা-নিরাশা— বিপুল গ্রন্থসম্ভারের কয়েকটি মাত্র নাম। ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর ধারাবাহিক আপিলা চাপিলা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। শেষ জীবনে পত্নী-বিয়োগের শোক সামলে, অশক্ত শরীরেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর মতপ্রকাশের উদ্যম ছিল অফুরান। সায়াহ্নে ‘আরেক রকম’ পত্রিকার সৃষ্টি ও লালনে তাঁর উৎসাহ ও পরিশ্রম বহু বিশিষ্ট জনকে মুগ্ধ করেছে।

ছিলেন অর্থশাস্ত্রের লোক। কিন্তু কবিতার প্রতি তাঁর টান অকৃত্রিম। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ তন্ন তন্ন করে পড়েছেন। প্রথম জীবনে তাঁর লেখা হলদে প্রজাপতি-কে পরে সশ্রদ্ধ স্মরণ করেছেন অনুজ কবি। আবার কোনও এক বছরে তাঁর পড়া উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম জানতে চাইলে তিনি নিজেই নিঃসঙ্কোচে বলেছেন, ‘গীতবিতান’! তাঁর চেতনায় ছেয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ আর কার্ল মার্ক্স।

অর্থশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের সুবাদেই সত্তরের দশকের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সেই দায়িত্ব ছেড়ে আসার পরেও কেন্দ্রীয় কৃষি মূল্য কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বাংলার রাজনীতি তাঁকে প্রথম নজর করে জরুরি অবস্থার সময়ে। ইন্দিরার পতন ঘটানো যে ১৯৭৭-এর লোকসভা ভোট, সেই সময়টায় বাম সাংসদ জ্যোতির্ময় বসুর নির্বাচনী প্রচারের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের পরেই জ্যোতি বসু ঠিক করে ফেলেছিলেন, রাজ্যে বাম সরকার হলে অশোকবাবুই হবেন প্রথম অর্থমন্ত্রী। সেই অঙ্ক থেকেই কয়েক মাস পরে বিধানসভা ভোটে রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে সিপিআইএমের প্রার্থী হয়ে জয় এবং রাজভবনে বাম সরকারের প্রথম পাঁচ মন্ত্রীর এক জন হয়ে শপথগ্রহণ।

পাঁচ বছর জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লড়াই। শহরে ফিল্মোৎসব সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে বলে সিনেমা হলের কর্মীদের ধর্মঘটের সময়েরও বেতন মিটিয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধানের মতো সাড়াজাগানো সিদ্ধান্ত। এবং, অবশ্যই, সঞ্চয়িতা লগ্নি সংস্থার দুর্নীতি দমনে ঐতিহাসিক অভিযান, আজকের পশ্চিমবঙ্গে যা কল্পকাহিনি মনে হতে পারে। পরে ১৯৮২-র নির্বাচনে রাসবিহারীতেই হৈমী বসুর কাছে পরাজয়। কিন্তু জ্যোতিবাবুর তাঁকে দরকার। শঙ্কর গুপ্তের আকস্মিক প্রয়াণে এক বছর পরেই খালি হল যাদবপুর কেন্দ্র। সুভাষ চক্রবর্তী তখন চেষ্টা করছেন যাদবপুরে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী করতে। শিষ্যের ইচ্ছা উড়িয়ে জ্যোতিবাবু বাছলেন অশোকবাবুকেই এবং তিনি জিতে ফের অর্থমন্ত্রী। তখন কারও কল্পনাতেই নেই যে, তিন বছরের মধ্যে সেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতের অমিলেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন অর্থমন্ত্রী! চৌরঙ্গিতে ’৯১-এর সেই পরাজয়ের দু’বছর পরে অশোকবাবুকে রাজ্যসভার সাংসদ করেছিল সিপিএম।

ভোটে হেরে মাঝের যে সময়টায় সরকারে তিনি ছিলেন না, তখনই পেশ হয়েছিল অশোকবাবুর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। যেখানে সুপারিশ ছিল প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজি তুলে দেওয়ার। রাজ্য জু়ড়ে বিতর্ক এবং আন্দোলনের জেরে এবং সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়েছে বুঝে বামফ্রন্ট সরকার পরে ইংরেজি ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু অশোকবাবু মত বদলাননি। তিনি মনে করে এসেছেন, প্রাথমিক স্তরে চেতনার বিকাশের জন্য মাতৃভাষাই আদর্শ মাধ্যম। একই ভাবে তাঁর অর্থনীতির যুক্তিতেও তিনি চিরকাল একরোখা। মনমোহন সিংহের সঙ্গে তাঁর সুন্দর ব্যক্তিগত সম্পর্ক। অথচ ভারতে নব্য উদারনীতির ভগীরথ মনমোহনকে ক্ষমা করেননি! ব্যক্তি আর অর্থনীতি এক নয়, বিশেষ করে তাঁর কাছে, অর্থনীতিকে যিনি দেখেন বিজ্ঞান হিসেবে নয়, রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে।

মার্ক্সবাদী তত্ত্বে নিজেকে দীক্ষিত করেছিলেন নিজের মতো করে। যে শিক্ষার সুবাদে তাঁর করে যাওয়া যাবতীয় মূল্যায়নই নিজের নীতি, যুক্তি এবং, অনেক সময়েই, রুচি-পছন্দের নিরিখে। বাম রাজনীতিতে যাঁদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা সংশ্লিষ্ট মহলে সকলেই জানেন, তাঁদের নিয়েও একটা অপ্রীতিকর শব্দ বাইরে উচ্চারণ করেননি! বলেছিলেন, সদস্যপদ ছেড়ে দিলেও দলের প্রতি ‘নিমকহারামি’ করবেন না! নিজে ছেড়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাম সরকারের ৩০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধায় উপস্থিত হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেছেন। আবার শঙ্কর সেন, মালিনী ভট্টাচার্যদের নিজে এগিয়ে দিলেও প্রকাশ্যে তাঁদের জন্য বাড়তি কোনও উচ্ছ্বাস দেখাননি।

জ্যোতিবাবু বলতেন, কমিউনিস্টরা কখনও অবসর নেন না। অশোকবাবুর মন্ত্রও যেন ছিল তা-ই। রাজ্য জুড়ে অরাজকতার অন্ধকারের ছবি যখন উঠে আসছে তাঁর কলমে, তখনও তিনি চেয়েছেন কিছু করে যেতে। সেই তাগিদ থেকেই গত বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে তীব্র মন্তব্য করেছেন, শপথ করেছেন অসমর্থ শরীরে ভোটের দিন দরকারে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও ভোটকেন্দ্রের পর্দায় ঘেরা যন্ত্রে নিজের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ প্রয়োগ করবেন! অন্য কিছু যদি করার না-ও থাকে, লিখে আর নিজের ভোটের অধিকারটি প্রয়োগ করে প্রতিবাদ রেখে যাবেন।

আচরণে তিনি বরাবরই আপাত-রুক্ষ। বহু লোকের কাছেই ‘খিটখিটে’। কিন্তু বহিরঙ্গের এই রুক্ষতার আড়ালেই বন্ধুবৎসল, স্নেহশীল একটি মানুষের বসত ছিল। যাঁরা তাঁর নিকটজন হয়েছেন, তাঁরা পেয়েছেন ভিতরের নরম মানুষটির পরিচয়। তাঁদের অনেকেই ভেবেছেন, কিছুতেই তিনি ভদ্রলোক নন, বাইরে এটা জানান দেওয়ারই তাগিদ থাকত সব সময়। একটা কর্কশ দেওয়াল তুলে রাখতেন নিজের সামনে, পাছে কেউ নরম মনটিকে দেখে ফেলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন